কেমন এক গা–ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ। অদ্ভুত ঘোরলাগা সংগীতে পুরো পরিবেশটা যেন ভুতুড়ে হয়ে ওঠে। ‘আনিস, আনিস!’ বলে ডেকে ওঠেন কেউ।
দেবীর বেশে মঞ্চে আসা জয়া আহসানকে ভীষণ কৌতূহলী কণ্ঠে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক জানতে চান, ‘আপনি আমাকে ডাকছেন?’ জয়া আনিসুল হককে নিরাশ করেন, ‘না তো! আপনার নাম আনিস? আমার স্বামীর নামও আনিস।’
‘দেবী’ চলচ্চিত্রের হুবহু দৃশ্যায়ন অবশ্য হয় না। জয়া তথা ‘দেবী’র সূত্র ধরে আনিসুল হক মঞ্চে ডেকে নেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে। এখানে ছোট্ট একটা অভিনয় করতে হয় প্রথম আলোর সম্পাদককে। সেটুকু করতে গিয়েই তিনি অনুভব করেন, অভিনয় করা কতটা কষ্টের! এ শ্রমসাধ্য, এ কষ্টের কাজটা চার দশক ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছেন আলী যাকের। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, সুদীর্ঘ অভিনয়জীবনকে সম্মান জানানো হয়েছে ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’ অনুষ্ঠানে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’ আয়োজনে এবার আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে আলী যাকেরকে। দেশের এ গুণী শিল্পী একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তবে আজকের এই পুরস্কার তাঁর কাছে পাচ্ছে আলাদা মাত্রা, ‘আজ পর্যন্ত এমন কিছু করিনি, যাতে দেশ কিংবা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরং দেশের কল্যাণে, প্রগতির জন্য সব কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছি। আমাকে এ সম্মান জানিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের জানাই ধন্যবাদ। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
রঙিন আলোর রোশনাই, সাজসজ্জার জাঁকজমক আর তারার দ্যুতিতে গত দুই দশকে ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’ দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে হয়ে উঠেছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। আজ অনুষ্ঠানটির ২১তম আয়োজনেও থাকল সেটিরই ধারাবাহিকতা। নাচে-গানে, হাসি-রসিকতায়, উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য এনে স্বীকৃতি জানানো হলো গত বছরের চলচ্চিত্র, টিভি, সংগীতাঙ্গনের সেরাদের। শুধু সেরাদের উপস্থিতি নয়, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র পরিণত হয় তারাদের মেলায়।
মেলার শুরুটা বেঙ্গল পরম্পরার চমৎকার পরিবেশনায়। পরম্পরার শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩০ মিনিটের এ পরিবেশনা শেষে ২১তম আসরের স্বাগত জানালেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। স্বাগত বক্তৃতায় তিনি বললেন, ‘আমরা সব জায়গায় বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই। গত শতকের ৬০-৭০ দশকে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল আমাদের গান, আমাদের নাটক। আশা করি, বাংলাদেশকে আবারও জাগিয়ে তুলবে আমাদের সংস্কৃতি। আজ বিদেশি সিনেমা দেখতে যদি মানুষ ভোররাত থেকে টিকিটের জন্য লাইন ধরে, বাংলাদেশে ভালো সিনেমা হলে সেটি দেখতেও আশা করি এমনই ভিড় হবে। এ কারণেই আগামীর চলচ্চিত্র নির্মাতা তৈরিতে আমরা একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।’
প্রথম আলোর সম্পাদক যে কর্মসূচির কথা বললেন, সেটির আওতায় নির্বাচিত করা হয়েছে ১০ জন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাকে। তাঁদের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয়েছেন তাসমিয়া আফরিন, লস্কর নিয়াজ মাহমুদ ও তানভীর মাহমুদ চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের আরেক আয়োজক স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বললেন, ‘২১ বছর ধরে অনুষ্ঠানটা আয়োজন করা হচ্ছে। ২১ বছর আগে যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা আজ পুরস্কার দিচ্ছেন। এই যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমরা কাজের স্বীকৃতি পৌঁছে দিচ্ছি, এটাই আমাদের প্রাপ্তি। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনকে মুখরিত করে রাখতে প্রধানমন্ত্রীকেও ধন্যবাদ জানাতে হবে।’
প্রতিবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের বড় আকর্ষণ থাকে উপস্থাপনায়। এবারও কৌতূহল ছিল কে বা কারা করতে যাচ্ছেন জমকালো এ অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা। আগের মতো এবারও উপস্থাপনায় চমক—একক কিংবা যৌথভাবে নয়, উপস্থাপনা হলো নদীর মতো নানা বাঁক নিয়ে। শুরুতে আনিসুল হকের সঙ্গে জয়া এলেন তো পরে উপস্থাপকের ব্যাটন তুলে দেওয়া হলো চঞ্চল চৌধুরীর হাতে। ২৬ এপ্রিল, শুক্রবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠান হলেই নাকি তিনি উপস্থাপনা করবেন, এটিই নিয়ম! ২০১৩ সালে এ দিনেই উপস্থাপনা করেছিলেন। সামনে এ তারিখে অনুষ্ঠান হলে তিনি উপস্থাপনা করবেনই। চঞ্চল যখন নাটুকে সংলাপে কথাগুলো বলছিলেন, পাশ থেকে আরেক উপস্থাপক ফেরদৌস অট্টহাসিতে জানিয়ে রাখলেন, আগামী ১০০ বছরেও শুক্রবারে ২৬ এপ্রিল পড়ার সম্ভাবনা নেই!
চঞ্চল অবশ্য ফেরদৌসকে খোঁচা দিলেন কদিন আগে তাঁর ভারত থেকে ফিরে আসার ঘটনা নিয়ে। ফেরদৌসও কম যান না, চঞ্চলকে অভিহিত করলেন ‘লুঙ্গি অভিনেতা’ বলে। বেশির ভাগ নাটক-সিনেমায় লুঙ্গি পরা চরিত্রেই নাকি চঞ্চল অভিনয় করেন! দুজনের এ তর্কের মধ্যেই পটকা-বাজির শব্দ! ‘পাটাকা’ গান দিয়ে আলোচিত নুসরাত ফারিয়া এলেন মঞ্চে। চঞ্চল-নুসরাত-ফেরদৌসের ত্রিভুজ রসায়নে এগিয়ে চলল জাঁকালো অনুষ্ঠানটি। এরই ফাঁকে ফাঁকে দেওয়া হলো সেরাদের পুরস্কার।
পুরস্কারপ্রাপ্তিতে মানুষ শুধু হাসেই না, কাঁদেও। যেমন কাঁদলেন পরীমনি আর শবনম ফারিয়া। তবে তাঁদের কান্না হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি গানের তালে অপূর্ব-পূজা, নিশো-তিশা, সিয়াম-মেহজাবীনের অনবদ্য পরিবেশনায়। কিংবা অবন্তি সিঁথি আর রাহুল আনন্দের চমকপ্রদ বাদ্য বাজনায়। অথবা ভারতীয় অনুষ্ঠান সারেগামাপার সৌজন্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া নোবেলের গানে। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া মীর সাব্বিরের ‘সিস্টেমরে তুই অপরাধী’ গানটাও কম আনন্দদায়ী ছিল না!
অনুষ্ঠানে যতবার নেপথ্য সংগীত বাজানো হয়েছে, ততবারই মনে পড়ে গেছে আইয়ুব বাচ্চুকে। গানটা তো তাঁরই গাওয়া। গত অক্টোবরে প্রয়াত দেশের এ কিংবদন্তি শিল্পীকে জানানো হয়েছে বিশেষ শ্রদ্ধা। তাঁর ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ গানটা গেয়ে শুনিয়েছেন বাপ্পা মজুমদার, নকিব খান, মানাম আহমেদ ও নাসিম আলী খান। গানের সময় ব্যাকড্রপে ভেসে ওঠা আইয়ুব বাচ্চুর ছবি যেন সবাইকে নস্টালজিক করে তুলছিল ক্ষণিকের জন্য।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার সুনাম আছে মেরিল-প্রথম আলোর। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। ৫টা ৫০ থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে ৯টা, কখন যে সময়টা পেরিয়ে গেছে টেরই পাওয়া যায়নি। তারার মেলায় ঘোর লাগা সময় যে এভাবেই কাটে!
আরও পড়ুন...