প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের মৃত্যুতে চলচ্চিত্র অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গত ৩০ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ভবানীপুরের নিজ বাসভবনে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ২০০১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ১৪ বেলতলা রোডে মৃণাল সেনের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। অপ্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ থেকে মৃণাল সেনের কলকাতায় পাড়ি জমানোর কথাসহ আরও অনেক কিছু।
নাসির আলী মামুন: আপনি ১৯৪০-এ কলকাতা গেলেন, কেমন ছিল চল্লিশের কলকাতা?
মৃণাল সেন: মারমুখী, ভয়ংকর! মানুষ বন্যার জলের মতো এদিক থেকে ওদিক...ছুটছে। আপাতত মনে হলো, কোনো গন্তব্য নেই তাদের। অনেক কুকুর খাবারের খোঁজে শহরময় শোরগোল করে চলে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা গলিতে ওদের চেঁচামেচি। ছোট শহরগুলো থেকে চাকরি ও আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন মানুষ এসে কলকাতায় ভিড় করছে। তারা কেউ ফিরে যেতে পারছে না। বৃদ্ধ–শিশু বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ সবাই মিলে গাদাগাদি অবস্থা। শ্বাস নিতে পারছে না শহর কলকাতা। শিশুদের মুখগুলো কেমন ভীতিকর পাণ্ডুর নিস্তব্ধ। চোখের দিকে তাকালেই আঁতকে উঠতে হয়। আমার পকেটশূন্য, তাদের দিকে তাকানো যায় না। সবাই মানুষ, কোনো ধর্ম নেই। কে হিন্দু কে মুসলমান চেনার দরকার নেই। রাজনৈতিক আন্দোলনের বিপক্ষে এ যেন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, যা আমার সম্পূর্ণ অচেনা। ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়ির সামনের আবর্জনার মধ্য থেকে মানুষ ও কুকুর খাবার খুঁজতে থাকে, এমন দৃশ্য দেখে বাড়িতে ফিরে যেতে চাইলাম। তা ছাড়া কলকাতায় কোনো থাকার জায়গার পাকা ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। আমি তখন প্রায় সতেরো বা কিছু বেশি বয়সের এক ক্লান্ত যুবক। পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট শহর থেকে এসেছি। সবকিছুই আমার জন্য নতুন। ভয়ার্ত সব চিত্র দেখে বাড়ি ফেরার কথা ভাবতে হচ্ছিল। পূর্ব বাংলা থেকে প্রতিদিন মানুষজন আসছে। কলকাতার প্রধান রাস্তাগুলোর দুপাশ শরণার্থীদের ভিড়ে ঠাসা। রাস্তায় না–খাওয়া মানুষদের দেহ পড়ে আছে, এটা যেন স্বাভাবিক অবস্থা কলকাতা নগরের। কিন্তু আমার মতো ছোট শহর ফরিদপুর থেকে আসা একজন, এমন দৃশ্য দেখে অস্থির হয়ে গেলাম। কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে স্ট্রেনজার মনে হতে লাগল।
কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। একদিকে রাজনৈতিক আন্দোলন অন্যদিকে মানবিক বিপর্যয়—সব মিলিয়ে এমন একটা অবস্থা, যা এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গান্ধীজির নেতৃত্বে তখন এমন এক অবস্থানে, তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এসব থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি হচ্ছিল না। কাগজ খুললেই একদিকে মানুষের মৃতদেহ এবং একই সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন...কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সিনেমার খবর থাকত। সবই আমি পড়তাম অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে। মানে এসব কিছু-কিছু আছে...খণ্ড খণ্ড, কোথায় যে রেখেছি...লিখেছি, ছিল, এখন কোথায় গেছে বলতে পারব না। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে অপ্রত্যাশিত এবং ভয়ংকর অধ্যায়, তা যেন সিনেমার মতো মফস্বলের এক যুবকের বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গেল। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে যে দৃশ্য দেখতে হলো, তা ছিল আমার জন্য নতুন কোনো দুর্ঘটনা। কলকাতার পথে পথে ঘুরে যা প্রত্যক্ষ করলাম, সেটি অভাবিত এবং বর্বর। পীড়া দিতে লাগল, আমরা কি মানুষ! ব্রিটিশরাও চাচ্ছিল রাজনীতি অন্যদিকে সরিয়ে দিতে। অসহায় মানুষদের দুর্দশা নিয়ে রাজনীতি করেছে তারা, আমল দেয়নি। স্বাভাবিকভাবে ওদের সিদ্ধান্ত ছিল, ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরিয়ে রাখা। ধনী ও প্রভাবশালীরা ওদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে ব্যবসা করছিল। কলকাতায় নিয়মিত রেশনিং প্রায় বন্ধ। খাদ্যদ্রব্যের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। চিনি ও দুধ নাগালের বাইরে, বাচ্চারা খাবে কী, মরতে হচ্ছে! রাতে শহর কলকাতায় মহড়া, লাইট থাকে না, বিদ্যুৎ চলে যায়। মাঝেমধ্যে সাইরেন বেজে ওঠে। এসব বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ভাবলাম, আর কত দিন...আমি চলে গেলাম ফরিদপুর।
মামুন: ফরিদপুরে কী দেখলেন?
মৃণাল: তেমন কিছু না। ছিমছাম, পদ্মাপারের সেই ছোট শহর। শহরের মধ্য দিয়ে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড সরাসরি কলকাতায় চলে গিয়েছে। এখানে রাতে বাতি নেই। ঘোড়ার গাড়ি, সাইকেল। বাড়িতে এসে কদিন বেশ মাছ-ভাত খেলাম। সবাই আমাকে দেখতে আসে, বলে, আমার ওজন নাকি কমেছে। খাচ্ছি-দাচ্ছি আর গল্প করছি। সহপাঠীরা এসে সবাই জানতে চাইছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের কী অবস্থা, কত দূর। বন্ধুরা কলকাতার গল্প শুনতে জাপটে ধরছে। জানলাম, আমাদের শহরের বেশ কিছু হিন্দু পরিবার, যাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল, তারা কলকাতায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি প্রায় সকালে গিয়ে তাদের বাড়িতে হাজির হয়ে কলকাতার রাস্তায় যা দেখেছি তা সবিস্তারে বলতে লাগলাম, যাতে তারা দুর্দশায় মধ্যে গিয়ে বিপদে না পড়ে। আমার গল্প শুনে তাদের অভিভাবকেরা বিশ্বাস করেনি আমাকে, তারা চলে গেল বাস্তবতা জেনেও। দেখলাম, এক রাতের মধ্যে কয়েকটি হিন্দু পরিবার প্রতিবেশী মুসলমানদের কাছে না বলে চলে গেল ভারতে। বন্ধুরা চলে যাচ্ছে। আমি দেখলাম, একা হয়ে যাচ্ছি। আমার বাড়ির কাছে রাজেন্দ্র কলেজ, প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে একদিন দেখা করতে গেলাম। তিনিও আমাকে পরামর্শ দিলেন হায়ার স্টাডি করতে, কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা করতে। আলীপুরের কাছে অরোরা টকিজ-এ গিয়ে সিনেমা দেখলাম কলকাতা থেকে কি যেন ওটা...অ্যা অ্য এ্যা। দেখি, মনে করতে পারছি না।
মামুন: আপনি তো প্রথম পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে অরোরা সিনেমা হলে গেলেন। সেখান থেকে আপনার মনে হলো...
মৃণাল: সাউন্ড। নির্বাক ছবি দেখছিলাম মায়ের পাশে বসে। একটা সিনেমায় দেখা গেল, বৃষ্টির মধ্যে নায়িকা দৌড়ে চলে যাচ্ছে। তখন হঠাৎ সিনেমা হলের টিনের ছাদে বৃষ্টির আওয়াজ। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন প্রথম আমার মনে হচ্ছিল, সিনেমার জন্য সাউন্ড অপরিহার্য। সাউন্ড ছাড়া চলচ্চিত্র হতে পারে না।
মামুন: আপনি চার্লি চ্যাপলিনের অনেক ছবি দেখেছেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আপনার বই লিখতে হলো কেন?
মৃণাল: আপনি যেভাবে বলছেন সেটি মনে হচ্ছে আমাকে দিয়ে কেউ কাজটি করিয়েছে। চ্যাপলিন পৃথিবীর বহু নামীদামি ব্যক্তিদের দখল করে নিয়েছে। আমি যখন সিনেমায় ঢুকিনি তখন ‘চার্লি চ্যাপলিন’ লিখেছিলাম। সত্যজিৎ রায় প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন ১৯৫৩-তে। পরে আমি সিনেমায় হাত দিই। কিন্তু এখন পর্যন্ত চ্যাপলিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সত্যজিৎ রায়ও বহুবার তাঁর প্রশংসা করেছেন। চ্যাপলিন এমন একজন ব্যক্তি, তিনি শুধু অভিনেতা নন। পৃথিবীর মানুষদের জন্য তিনি এক মানবিক প্রতিনিধি। আজ পর্যন্ত অন্য কোনো অভিনয়শিল্পীর মধ্যে চার্লি চ্যাপলিনের মতো কাউকে দেখি না। তাঁর অভিনয় আসলে কৌতুক নয়, অন্য এক আয়োজন চ্যাপলিনের সারা জীবনের পুরো সময়টায়। তিনি আমার কাছে শান্তি ও মানবতার এক জীবন্ত কিংবদন্তি। আমাদের মহাত্মা গান্ধীও চ্যাপলিনকে খুব পছন্দ করতেন। ওর পক্ষে বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার আছে মনে করি না। চ্যাপলিনের নাতনি কলকাতায় আমার বাসায় দেখা করতে এসেছিল।
মামুন: কলকাতার যেসব স্পর্শকাতর এবং মানবিক বিপর্যয়ের কথা বললেন আপনার সিনেমায় সেগুলোর প্রতিফলন—দেখলাম না কেন?
মৃণাল: আমি তো আগেই বলে দিয়েছি এসব হবে না। ফিল্ম নিয়ে কোনো কথা বলব না আমি...।
মামুন: আপনি ফরিদপুর আর কলকাতার কথাই বলুন...
মৃণাল: আপনারা আমার সিনেমাগুলো দেখেননি।
মামুন: দেখেছি, আমি নাম ধরে বলতে পারি।
মৃণাল: আচ্ছা শুনুন, আমি অন্যদের মতো কাহিনিনির্ভর ছবি তৈরি করিনি। আপনাদের বুঝতে দেরি হলে আমার তো কোনো দোষ নেই। কলকাতার ওপরে তো আমি কয়েকটি সিনেমা বানিয়েছি। বাস্তবতার বাইরে আমি যাইনি, অন্যরা কী করেছে সেটা দেখুন। আপনি যেটা জানতে চাইছেন, সেটা বলছি...ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার আমি নই। আমার সিনেমা জ্ঞান ও প্রমাণ দিয়ে বুঝতে হবে।