‘নাইলন শাড়ি, ফাউন্টেন পেন
উত্তম কুমারের পকেটে সুচিত্রা সেন’
ওপরের ছোট্ট অণুকাব্যটির রচয়িতা কে ছিলেন, সেটা জানা না গেলেও, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি মননে এই ছড়াটির যে বিশেষ এক তাত্পর্য ছিল, তা বলাই বাহুল্য।
বাংলা ফিল্মের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটিকে নিয়ে এ ধরনের অণুকাব্য যে মানুষের মুখে মুখে ফিরবে, তা তো বলাই বাহুল্য। উত্তম পরলোকে গেছেন আজ থেকে ৩৩ বছর আগে, সুচিত্রা চলে গেলেন আজ। জুটি বেঁধে তাঁরা বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন ৩০টিরও অধিক ছবি—যার প্রায় সবগুলোই সিনেমার ব্যবসায়িক মানদণ্ডে ‘সুপারহিট’। পঞ্চাশ-ষাট ও সত্তর—এই তিন দশক রুপালি পর্দায় তো ছিলেনই, স্যাটেলাইট টেলিভিশন আর ভিডিও প্রযুক্তির কল্যাণে উত্তম-সুচিত্রা জুটি জনপ্রিয় পরের প্রজন্মগুলোর কাছেও। রোমান্টিকতায় ভরপুর এ জুটি বাঙালিকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ভালোবাসতে হয়। কীভাবে রোমান্টিক বাতাবরণ তৈরি করে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দিতে হয় সবাইকে। উত্তম কুমার চলে গেছেন অপরিণত বয়সে। সেই তুলনায় সুচিত্রার প্রস্থান বয়সের পরিপূর্ণতা নিয়েই। কিন্তু যত দিন বাঙালি থাকবে, বাংলা সিনেমা থাকবে, তত দিনই এই জুটি সিনে-সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিক ব্যাপার। নিজেদের মেধা, প্রতিভা আর অভিনয়শৈলী দিয়েই এই অমর জুটি অর্জন করেছেন তাঁরা।
আগেই বলা হয়েছে, উত্তম-সুচিত্রা জুটি রুপালি পর্দার এমনই এক প্রেমিক-যুগল, যা চিরদিনের। এই জুটির পঞ্চাশের দশকের কোনো ছবির একটি রোমান্টিক দৃশ্য দেখলেও আজকের প্রেমিক হূদয়ে তোলপাড় ওঠে। তাঁদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি সংলাপ যেন কাল অতিক্রম করে চলে গেছে বহুদূর। আজকের স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনস কিংবা কম্পিউটার প্রযুক্তির এই চরম উত্কর্ষতার যুগেও তাই সুচিত্রা সেনের চলে যাওয়া এই প্রজন্মের কাছে রূদ্ধশ্বাস আলোচনার বিষয় হয়। কিংবদন্তি বোধ হয় একেই বলে।
১৯৭৮ সালের পর সুচিত্রা সেন কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। ৪৭ বছর বয়সে অভিনীত তাঁর শেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’ ব্যবসায়িক দিক দিয়ে মার খাওয়ার পর কিছুটা অভিমানেই তিনি চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। এরপর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সুচিত্রা কখনোই জনসমক্ষে আসেননি। তিনি নিজের চারদিকে অদ্ভুত এক বাতাবরণ তৈরি করে নিজেকে বানিয়ে ফেলেছিলেন এক রহস্য। এই প্রজন্ম ব্যাপারটিকে এক দিক দিয়ে ইতিবাচক হিসেবেই দেখে। এই প্রজন্ম খুশি যে তাদের কখনোই জীবনের স্বাভাবিক ধারায় বয়সের কাছে আত্মসমর্পণকারী উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে দেখতে হয়নি। তাদের কাছে উত্তম-সুচিত্রা জুটি চিরসবুজ, চিরতরুণ এক জুটি।
উত্তম-সুচিত্রা জুটির সবচেয়ে প্রথম হিট ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া হাসির এ ছবিটিতে উত্তম কুমার কিংবা সুচিত্রা সেন কেউই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেননি। এ ছবিটি যখন মুক্তি পায়, তখন ছাপানো পোস্টারে উত্তম-সুচিত্রার কোনো পাত্তাই ছিল না। ছবির প্রদর্শকেরা ব্যবসায়িক মানদণ্ডে চরিত্রাভিনেতা তুলসী চক্রবর্ত্তীকে পোস্টারের প্রধান মুখ বানিয়েছিলেন। কিন্তু ছবিটিতে উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক অভিনয় বাংলা সিনেমার জগতে যেন এক প্রলয়ের ডাক দিয়ে যায়। একটি চমত্কার রোমান্টিক জুটির জন্য হাপিত্যেশ করে ফেরা কলকাতার সিনেমাশিল্প যেন পেয়ে যায় এক কোরামিন। যে কোরামিন কলকাতার সিনেমাশিল্পকে স্বর্ণ সময়ে প্রবেশ করায়। এর পর পথে হলো দেরী, মরণের পর, শাপমোচন, শিল্পী, সাগরিকা, হারানো সুর, সবার উপরে, সূর্যতোরণ, চাওয়া-পাওয়া, সপ্তপদী, জীবনতৃষ্ণা, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, ইন্দ্রাণী, চন্দ্রনাথ, আলো আমার আলোর মতো ৩০টির বেশি ছবিতে এই জুটি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাটাই পাল্টে দেন সম্পূর্ণরূপে। হয়ে যান নারী-পুরুষের সম্পর্কের রোমান্টিকতার ধারণায় বাঙালির চিরকালীন এক আইকন।
রোমান্টিক জুটি হিসেবে উত্তম-সুচিত্রা নিজেদের নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক জগতে। তাঁদের জনপ্রিয়তা ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনায় আজও কোনো ক্লান্তি আসার কথা নয়। সুচিত্রার পোশাক অনুকরণ করতেন সেকালের যুবতীরা প্রায় সবাই। তাঁর শাড়ি পরা কিংবা চুল বাঁধার কেতা ছিল সেই সময়ে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কলকাতা, ঢাকার বাঙালি সমাজে অভিজাত্য ও ফ্যাশন-সচেতনতার প্রতীক। উত্তম কুমারের চুলের কেতাও অনুকরণীয় ছিল যুবকদের মধ্যে। তাঁর শার্টের কলার কেমন ধাঁচের কিংবা তাঁর স্যুটের কাটিং—সবই ছিল অনুকরণীয়। উত্তম-সুচিত্রার পোশাক-পরিচ্ছেদ এতটাই আধুনিক ও কালোত্তীর্ণ যে এই প্রজন্ম মনে করে সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমারের হাতে একটি মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ কিংবা একটি আইপ্যাড না থাকাটাই যা একটু অপূর্ণতা। এই আধুনিক গ্যাজেটগুলো ছাড়া উত্তম-সুচিত্রা চিরকালীন ও সর্বকালের একটি ব্যাপার।
উত্তম কুমার তাঁর জীবদ্দশায় একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না। এ আমার বিশ্বাস। আজ আমি উত্তম কুমার হয়েছি, কেবল ওর জন্য।’
সুচিত্রা সেনও আবার যখন উত্তমের সঙ্গে গড়ে ওঠার জুটির গণ্ডির বাইরে গেছেন, তিনিও সাফল্য পাননি। বলয়গ্রাস নামের একটি ছবিতে নায়িকাপ্রধান চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেও তিনি ছবিটিতে ছয় সপ্তাহের বেশি প্রেক্ষাগৃহে চালাতে পারেননি। উত্তম কুমারের বলয় ছিঁড়ে বসন্ত চৌধুরী কিংবা বিকাশ রায়ের সঙ্গে শুভরাত্রি ও সাজঘর নামের দুটি ছবিতে অভিনয় করেও তিনি সাফল্যের মুখ দেখেননি।
সুতরাং উত্তম-সুুচিত্রা পরস্পরের পরিপূরক এক জুটি। উত্তমকে ছাড়া সুচিত্রাকে কিংবা সুচিত্রাকে ছাড়া উত্তমকে দর্শকেরা একেবারেই দেখতে চাইতেন না। এ এক অবিচ্ছেদ্য জুটি। বাঙালিকে হাসানো, কাঁদানো আর রোমান্টিকতার উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দেওয়ার এই জুটি অদ্বিতীয়। বাঙালির জীবনে এই জুটির প্রভাব কখনোই অস্বীকার করা যাবে না। এই জুটি সব সময়ের। সুচিত্রা সেনের মহাপ্রয়াণের আজকের এই দিনটিও যেন ৩৩ বছর ধরে আলাদা উত্তম-সুুচিত্রা জুটির চার হাত আবারও এক করে দিল।