প্রস্তাবিত ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০১৯’ একটি দমনমূলক আইন হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন চলচ্চিত্রকর্মীরা। তাঁরা মনে করেন, এই আইন চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির জন্য ভীষণ বিপজ্জনক হবে; প্রস্তাবিত এই আইনটি নিয়ে অধিকতর বিচার-বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’ এর খসড়া প্রণয়ন করেছে এবং তা সর্বসাধারণের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করেছে।
গতকাল শনিবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনারকক্ষে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ (এফএফএসবি) আয়োজনে প্রস্তাবিত ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’ এর খসড়াপাঠ ও বিচার–বিষয়ক একটি জাতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সভাপতি স্থপতি লাইলুন নাহারের সভাপতিত্বে সভায় দেশের ৪০টি চলচ্চিত্র সংসদের প্রতিনিধি ছাড়াও তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক, চলচ্চিত্র গবেষক ও চলচ্চিত্রকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
সভার শুরুতে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি বেলায়াত হোসেন মামুন ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’ এর খসড়া পাঠ করেন। পাঠ শেষে তিনি সূত্র ধরিয়ে দেন। বেলায়াত হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্র–বিষয়ক আইনের একটি প্রধান সমস্যা হলো, এই আইনগুলো সবই প্রণীত হয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীদের স্বাধীনতাকে সীমিত করবার অভিপ্রায়ে। এই প্রবণতার শুরু হয় ১৯১৮ সালে প্রণীত সিনেমাটোগ্রাফ আইনের সূত্র ধরে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনের সময় ব্রিটিশ সরকারের যে মনোভাবে স্থানীয় মানুষদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনায় আইন প্রণীত হয়েছে, সেই একই ধারা আমরা পাকিস্তান পর্বে প্রণীত আইন এবং বাংলাদেশ পর্বে প্রণীত আইনে দেখতে পাচ্ছি। প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনটিও সেই একই ধরনের দমনমূলক আইন। এই আইনটির মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতা বা কর্মীর মত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়েছে, যা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইন অধিকতর আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়া গৃহীত হওয়া উচিত নয়।’
সভায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান, চলচ্চিত্র গবেষক আ আল মামুন। তিনি তাঁর আলোচনায় বলেন, ‘শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব না দিতে পারলে আমরা কোনোভাবেই উন্নতি করতে পারব না। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশে তা দেখা যায় না। বর্তমান বিশ্ব মানুষের স্বাধীনতার পরিসরকে ক্রমাগত বৃদ্ধি করবার চেষ্টা করছে। সেখানে আমরা যদি আমাদের শিল্পীদের, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীদের স্বাধীনতার পরিসরকে সংকুচিত করি, তবে আমরা উল্টো পথে আছি বলতে হবে। বর্তমান সকল আইনকেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচার করতে হবে।’ তিনি বর্তমানে চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বিবেচনায় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীদের অবাধ সৃষ্টিশীলতার পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বলেন, রাষ্ট্রের কাজ হওয়া উচিত শিল্প ও শিল্পীকে সহযোগিতা করা, তাকে বাধা দেওয়া নয়।
আলোচনায় আরও অংশ নেন জ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও এফএফএসবির সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়েছি একটি গণতান্ত্রিক ও অবাধ সার্টিফিকেশন পদ্ধতির। আমরা চেয়েছি সেন্সর বোর্ডের মতো পশ্চাৎপদ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার। কিন্তু দুঃখজনক হলো, যে আইনটি সরকার প্রস্তাব করেছে, তা পাঠে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এটা আগের যেকোনো আইনের থেকেও বেশি দমনমূলক আইন। এখানে রেটিং প্রস্তাব করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু এর পাশাপাশি চলচ্চিত্রকে কর্তন, বাতিল ও আইনগতভাবে হয়রানির সকল ব্যবস্থা প্রবলভাবে উপস্থিত আছে। তাহলে এটা কেমন সার্টিফিকেশন হলো?’
সভায় উপস্থিত ছিলেন এফএফএসবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সাবেক সভাপতি বিপ্লব মোস্তাফিজ। তিনি আলোচনায় বলেন, ‘এই আইনটির বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, এই আইন চলচ্চিত্রের ভালোর জন্য প্রস্তাব করা হয়নি। এই আইন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে আর সকল চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীকে আরও অসহায় করে তুলবে। তাই এই আইনকে আমাদের মনোযোগ দিয়ে বিচার করা উচিত। যে আইন চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিকে অবাধ না করে বেঁধে ফেলতে চাইতে পারে, তাকে গ্রহণ করবার কোনো কারণ দেখি না।’
এ ছাড়া সভায় আরও বক্তব্য দেন ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অদ্রি হৃদয়েশ, রণেশ দাশগুপ্ত চলচ্চিত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক রিপন কুমার দাশ, নারায়ণগঞ্জ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক কাজী জাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইমতিয়াজ পাভেল প্রমুখ। তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সাকী ফারজানা, পার্থিব রাশেদ, কাজী আতিকুল ইসলাম, তানভীর আহমেদ, রুমকী রুসা, কামরুন নাহারসহ আরও অনেকে।
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি স্থপতি লাইলুন নাহারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সভা সমাপ্ত হয়। চলচ্চিত্র নির্মাতাকে স্বপ্নবান একজন মানুষ মন্তব্য করে লাইলুন বলেন, ‘প্রত্যেক শিল্পীই তা–ই। এখন শিল্পী যদি স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় অথবা শিল্পীর স্বপ্ন যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবে তো শিল্প হবে না। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি আধুনিক, উদার, গণতান্ত্রিক সার্টিফিকেশন সিস্টেম যেন বাংলাদেশে প্রবর্তন করা যায়। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। যে আইনটি আজ আমরা পাঠ করেছি, তা খুবই নেতিবাচক একটি আইনের খসড়া।’