চলচ্চিত্র-প্রাণ এক পরিচালক

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন নির্মাতা তারেক মাসুদ। মৃত্যুর ষষ্ঠ বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
তারেক মাসুদ (৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬–১৩ আগস্ট ২০১১)
তারেক মাসুদ (৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬–১৩ আগস্ট ২০১১)

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের একটি কোর্সের এক তরুণ ছাত্রের মাথায় সিনেমার পোকাগুলো কুটকুট করে কামড়ায়। সাতসকালে হাজির চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেনের বাসায়। সিনেমা নিয়ে পড়তে বাইরে যেতে হবে। অগ্রজ এই সিনেওয়ালার কাছে পরামর্শ নেওয়া। আনোয়ার বললেন, ‘আজকের কাগজ দেখেছ? ইত্তেফাক খুলে দেখো।’ ব্যাক পেজে বড় করে নিউজ—শিল্পী এস এম সুলতান হাসপাতালে। ভীষণ অসুস্থ। ‘মনে আছে তুমি বলেছিলে, সুলতানের ওপর ডকুমেন্টারি করবে। তুমি যদি এখন পড়তে বাইরে চলে যাও, ফিরে এসে দেখবে সুলতান নেই।’ তরুণ বলল, ‘সব কাজ সেরে ফেলেছি, আমি চলে যাব।’

জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে যুবক। বাসটি দেরি করছে। আনোয়ার হোসেনের কথা ঘুরপাক খায় মনে। তরুণের মন পাল্টে যায়। সিদ্ধান্ত নেয়, বিদেশে পড়তে যাওয়ার টাকা দিয়েই সে ছবি শুরু করবে। একদিন এই তরুণ হলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ।

প্রকৃতির ছেলে

১৯৫৬ সাল। ফরিদপুরের মাটি যাঁকে জন্ম দিল, তিনি একদিন বানাবেন আদম সুরত, মুক্তির গান, মুক্তির কথা, মাটির ময়না, নরসুন্দর। ফরিদপুরের গ্রামীণ জীবন তরুণ তারেককে দিয়েছে অবারিত চিন্তার ফসল। মাঠে-ঘাটে সবুজ ঘাসফড়িংয়ের পিছু ছোটাছুটি। পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে কিশোর তারেকের মন প্রজাপতির ডানা হয়ে উড়ে বেড়ায়। বাবা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলেন মাদ্রাসায়। মাদ্রাসায় বসেই আঁকেন প্রজাপতি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পুরোটা কেটেছে আর্ট কলেজে। কলেজের অনেক জুনিয়র ছাত্র মনে করত, তিনি আর্ট কলেজের ছাত্র।

প্রথম পাঠ

আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে যখন পড়ছেন, তখন দেশের সদ্য জন্ম হয়েছে। চাচাতো ভাই শাহীদুর রহমান ও খুকু ভাবির (সুলতানা শাহীদ) বাসায় থাকেন। তারেক শুনতে পান খুকু ভাবির বড় ভাই সিনেমার সঙ্গে জড়িত। আলমগীর কবির নাম। একদিন তাঁর বাসায় উপস্থিত তারেক। তারেকের ভাষায়, ‘সেদিন তিনি একটি রুম থেকে বেরিয়ে এসে রাশভারী কণ্ঠে বললেন, “এই, শোনো, তুমি এই দিকে এসো”, বলে তিনি আমাকে সেই রুমে নিয়ে গেলেন। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। দরজা-জানালা সব বন্ধ। জানালা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। তিনি আমাকে বসতে বললেন। তারপর একটা যন্ত্র চালু করলেন। ১৬ মিলিমিটার প্রজেক্টর। তিনি বললেন, “এবার দেখো।” আমি দেখলাম। একটা অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। সেটি হচ্ছে পথের পাঁচালী।’

তারেক বিস্মিত। একটি ছবি কী করে জীবনের এত কাছাকাছি হতে পারে। সিনেমার চরিত্র অপু লাজুক, ভীরু একটা ছেলে। তারেকও তাই। তারেকের জীবনে ছবিটি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের প্রথম পাঠ হয়ে দাঁড়ায়। একদিন পথের পাঁচালীর অপুই হয়ে উঠবে মাটির ময়নার আনু। আনু আসলে তারেকই।

মাটির ময়না ছবির দৃশ্য

সিনেমা দেরিতে

নটর ডেম কলেজ থেকে পাঠ চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় এখন তারেক। বেড়েছে জানাশোনা আর চেনাজানার পরিধি। ‘লেখক শিবির’, বাম আন্দোলন, বন্ধুবান্ধব, আড্ডাবাজি—তারেক উড়ছেন অন্য এক আকাশে। চলচ্চিত্রটা ঠিক তখনো তারেকের কাছে জুতসই লাগে না। কিন্তু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত একটি মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র দেখার পর সবকিছু আমূল বদলে গেল। সেখানেই পরিচয় সংসদ আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ মুহম্মদ খসরুর সঙ্গে। তারেক যুক্ত হলেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে। পরিচয় হয় মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, শামীম আখতার—কত চলচ্চিত্র-বন্ধুর সঙ্গে। যাঁরা একদিন চলচ্চিত্রকার হয়ে উঠবেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেছেন। এবার ফিল্ম বানানোর স্বপ্নটা যেন আরও কাছাকাছি। ১৯৮২ সাল। তারেক চিত্রশিল্পী সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র বানাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তবে ছবি বানাতে গিয়ে বুঝলেন, এটা সহজ কাজ নয়। সুলতানের সঙ্গ সিনেমার থেকেও তাঁকে দিল অন্য দীক্ষা। তারেক বলেন, ‘ছবিটা বানাতে গিয়ে আমি যতই বাস্তবতাবর্জিত কাজ করি না কেন, সুলতানের মতো এমন আলোকপ্রাপ্ত মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকা ও চলার ফলে আমার যে আত্মোন্নয়ন ঘটেছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। শুধু গ্রামবাংলা নয়, শিল্প সম্পর্কে জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা আমার মধ্যে বিকশিত হয়েছে।’

এদিকে তাঁর ছবির কাজ শুরুর পর তানভীর মোকাম্মেলের হুলিয়া ও মোরশেদুল ইসলাম আগামী বানানোর কাজ শুরু করেন। সেগুলো মুক্তিও পেয়ে গেল। কিন্তু তারেকের ছবি আর শেষ হয় না। এ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশার শেষ নেই। অনেকে বলাবলি করতে লাগল, ‘এস এম সুলতানের মৃত্যুর জন্য পরিচালক অপেক্ষা করছেন।’ অন্যদিকে তখন ‘সিনেমা ভেরিতে’ নামে একটি আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। এর বৈশিষ্ট্য ছিল, দ্রুত শুটিং শেষ করা এবং অনেকটা রাফ অবস্থাতেই ছবিটা দেখানো। তারেকও তখন বন্ধু মহলে তামাশা করে বলতেন, ‘আমি নতুন একটা আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছি, সেটা হচ্ছে “সিনেমা দেরিতে”।’ ছবিটি বানাতে সাত বছর লেগেছিল। হাল ছাড়েননি তারেক। তাঁকে যেতে হবে বহুদূর।

তোমাকে আমি ক্যাথরিন দিয়েছিলাম

১৯৮৭ সালের দিক। আহমদ ছফায় বুঁদ তরুণেরা। ছফা সেই সময়ের বোহেমিয়ান তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে আড্ডা দেন। বাংলাদেশে গবেষণা করতে আসা ক্যাথরিনও জড়িয়ে যান সে আড্ডায়। সেখানে পরিচয় তারেকের সঙ্গে। এরপর সংসার শুরু দুজনের। সে সংসার পরিবারের নয়, চলচ্চিত্রের। ক্যাথরিনের ভাষায়, ‘আমাদের দুজনের কখনোই সংসার নিয়ে চিন্তাভাবনা ছিল না। সংসার যে করব, আমাদের সেই অর্থ কোথায়? আমাদের কোনো বাড়িঘর নেই, কিচ্ছু নেই। কীভাবে আমরা সংসার করব! সে জন্য ধরে নিলাম, ছবিই আমাদের সংসার।’ সেই ছবির সংসার উপহার দিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে একজন ভালো প্রযোজকও। তারেকের অনেক ছবিরই প্রযোজক তিনি। তারেকের প্রথম ছবির সাবজেক্ট যেমন আহমদ ছফার আবিষ্কার, তেমনি ছবির সংসারের এই মানুষটিও ছফার আবিষ্কার। আহমদ ছফা তারেককে বলতেন, ‘তোমাকে আমি ক্যাথরিন দিয়েছিলাম।’

দুর্ঘটনা ডেকে নেয় চলচ্চিত্র-প্রাণ

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন তারেক। মাটির ময়নার প্রিকুয়েল কাগজের ফুল-এর কাজ চলছিল তখন। চলচ্চিত্রের যাত্রাপথেই তাঁর প্রাণ উড়ে গেল।