‘খাজনা’ দিয়ে শুরু, সর্বশেষ ‘গোলাপের কাঁটা’। এর মধ্যে কেটে গেছে চিরকুট ব্যান্ডের দেড় যুগ। কথা আর সুরে শ্রোতাদের আবেগে ভাসাচ্ছে, কখনো ভাবাচ্ছেও। এভাবেই চলছে। নাটক আর সিনেমার গানেও দলটি এনেছে নতুনত্ব। কবে যে ১৮ বছরে পা রাখল ব্যান্ডটি, তা মনে ছিল না। লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার গল্প শুনতে গিয়েছিলাম চিরকুট সদস্যদের কাছে। ১৩ জানুয়ারি ঢাকার হাতিরঝিলে ছবি তোলার ফাঁকে দলের সদস্যরা জানালেন তাঁদের চিরকুট–যাত্রার কথা।
শুরুর গল্প
সুমী, শোয়েব ও পারভেজ সাজ্জাদ— এই তিনজন মিলে চিরকুট ব্যান্ড শুরু করেন ২০০২ সালে। তাঁরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সুমীর নেতৃত্বে এরপর আরও অনেকে যুক্ত হন। পথ চলতে চলতে অনেকে চলেও যান। কয়েক বছর ধরে পাঁচ সদস্য নিয়ে কাটছে চিরকুটের দিনকাল। এখন সুমীসহ এই দলের অন্য সদস্যরা হলেন ইমন চৌধুরী, পাভেল আরীন, দিদার চৌধুরী ও জাহিদ নিরব। অতিথি হিসেবে ইদানীং মঞ্চে দেখা যাচ্ছে শুভ্র ও তামজীদকে। কী লক্ষ্য নিয়ে সুমী ব্যান্ড গড়েছিলেন এবং এ অবধি এসে কতটা সফল জানতে চাইলে বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলা গানের ভান্ডারে নতুন কিছু গান প্রতিষ্ঠিত করা—কিছুটা হয়তো পেরেছি। অনেকটা পথ বাকি। বাংলা গান শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন।’
বিদেশে সফর
আন্তর্জাতিক উৎসবসহ অনেক দেশে গান শুনিয়েছে চিরকুট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালয়েশিয়া। গান শোনানো নয়, দুটি দেশের ব্যান্ডের সঙ্গে নতুন গানও তৈরি করেছে দলটি। নরওয়ের কাসা মুরিলো ব্যান্ডের সঙ্গে যৌথভাবে ট্রামস অ্যান্ড এম্পটি স্ট্রিটস আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্প্যানিশ গানের দল টুয়েন্টি ফোর হরাসের সঙ্গে ‘অন্তরে বাহিরে’।
নাটক ও সিনেমার গানে
প্রথম অ্যালবাম চিরকুটনামা প্রকাশিত হওয়ার পর নাটক আর সিনেমার গানেও নাম লেখায় চিরকুট। নাটকে প্রথম গান ‘যাদুর শহর’ আর সিনেমায় ‘কানামাছি’। দলের সদস্য পাভেল বলেন, ‘আমরা কাজের ব্যাপারে বরাবরই সজাগ ছিলাম। নাটক ও সিনেমায় যখন সাফল্য পেলাম তখন অনেক গান করার প্রস্তাব এল। আমরা কিন্তু লুফে নিইনি।’
নাটক আর সিনেমায় চিরকুটের তৈরি উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে ‘একটা ছেড়া দিন’, ‘লেজে রাখা পা’, ‘না বুঝি দুনিয়া’, ‘আহারে জীবন’, ‘এই শহরের কাকটাও’ ও ‘আটকে গেছে মন’। সুমী জানান, আরও তিনটি ছবির গান নিয়ে এখন কাজ করছে চিরকুট। ছবিগুলো হচ্ছে রিকশাগার্ল, মানুষের বাগান ও বিউটি সার্কাস।
পাশের রুমের ছেলেটি
পাশের ঘর থেকে যে তরুণ ইমনের গিটার আর পাভেলের ড্রামস শুনতেন, তিনি এখন এই দলের অপরিহার্য সদস্য। ২০১০–এর দিকে খাজনা গানটা শুনেই দলটির প্রেমে পড়েন জাহিদ নিরব। তিনি এখন চিরকুটের কি–বোর্ডিস্ট ও কম্পোজার। নিরব বলেন, ‘আমার ব্যাকগ্রাউন্ড যেহেতু ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল, তাই চিরকুট আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তখন আমি এক আনকোরা মিউজিশিয়ান। ওই সুবাদে চিরকুটের মগবাজার স্টুডিওতে যেতাম। পাভেল ভাই ড্রামস বাজাতেন, বাইরে থেকে শুনতাম। ইমন ভাইয়ের রুমের পাশে ছিল আমার রুম। সারা রাত গিটার প্র্যাকটিস করছেন, আমি শুনছি। আমার এক বন্ধু বলল, তোর এ ধরনের ব্যান্ডে বাজানো উচিত। বললাম, ধুর ব্যাটা, কী বলিস (হাসি)। এরপর কীভাবে যেন হয়ে গেল।’
ভক্ত যখন চিরকুটের সদস্য
দুই মাস হচ্ছে চিরকুটে অতিথি হিসেবে বাজাচ্ছেন তামজীদ আর শুভ্র। তাঁরা দলটিতে সর্বকণিষ্ঠ। ডিসেম্বরে ঢাকার মঞ্চে অভিষেক হয়েছে। তামজীদ বললেন, ‘আমি তখন ক্লাস এইটে যখন প্রথম চিরকুটের কনসার্ট দেখি। ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের সেই কনসার্টে স্কুলের বন্ধুরা মিলে চিরকুট চিরকুট করে গলা ফাটিয়েছি। ভাবিনি, এই দলে বাজাব!’
১৮ বছরের শপথ
‘আমরা উদ্যাপন করতে চাই। কারণ, ১৮ মানেই সাহস, তারুণ্য, উদ্দীপনা ও অদম্য শক্তি। আমাদের ব্যান্ডের ক্ষেত্রেও তাই।’ এভাবেই বললেন সুমী। জানালেন সামনের পরিকল্পনা, ‘এ বছর ১৮ টা গান করার পরিকল্পনা আমাদের।’ জানা গেছে, নেপাল, অষ্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরে কনসার্ট করবে দলটি। ইউরোপ ও আমেরিকাতেও কয়েকটি কনসার্টের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। ভিসা চূড়ান্ত হলে নিশ্চিত বলতে পারবে চিরকুট।
চিরকুট ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপ তামজীদ (বেজ গিটার, অতিথিশিল্পী), নিরব (কিবোর্ডিস্ট ও কম্পোজার), শুভ্র (রিদম গিটার, অতিথিশিল্পী), ইমন (লিড গিটার, ব্যাঞ্জো, মেন্ডোলিন), পাভেল আরীন (ড্রামস ও মিউজিক প্রডিউসার), সুমী (গীতিকার, সুরকার ও ভোকাল) ও দিদার (বেজ গিটার)