>পাঁচ দিন ঢাকায় ছিলেন উপমহাদেশের সমকালীন আলোচিত বাউল পার্বতী দাস। জাতীয় নাট্যশালায় এক সন্ধ্যায় সুর আর বাণীতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। তিন দিন স্থানীয় বাউলদের সঙ্গে কর্মশালা করতে গিয়ে অনেক কিছু শেখালেন, নিজেকে জানালেন তিনি। এসব নিয়ে লিখেছেন মাসুম আলী
জাতীয় নাট্যশালার সুবিশাল মঞ্চের ঠিক মাঝখানে তিনি। কপালে রসকলি (বৈষ্ণবদের তিলক)। পায়ে নূপুর, সারাক্ষণ ছন্দময়। কোমরের কাছে ডুগডুগি। মাথার জটা ছড়িয়ে গেছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। জটা ছড়িয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে। ডান হাতে সুর তুলছেন একতারায়। বাঁ দিকের কোমরের কাছে ঝুলছে ডু্গডুগি, বাঁ হাত দিয়ে যেখানে বোল তোলেন তিনি। গলায় সুর ওঠা–নামা করছে, অথচ তিনি ঘোরলাগা অবস্থায় নেচে চলেছেন। অভিনব এ পরিবেশনা!
তাঁর পরিবেশনা খুব সহজে মনে গেঁথে যায়। মনে ধরে তাঁর কথাগুলো। সুরে মিশে ছিল মাটি ও মানুষের কথা, বাউলের সাধনা ও তত্ত্বকথা। মঞ্চ ঘুরে যখন নেচে নেচে গান করেন, এক অপার্থিব আবহ তৈরি হয়। তাঁর বিশাল জটাধরা চুলে নৃত্য ভঙ্গিমায় কখনো অধরার কথা, আবার কখনো নিজেকে জানার, চেনার গল্প বলে যান ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
২৭ অক্টোবর শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালায় পাবর্তী দাস বাউল গাইলেন। ‘কী রূপ দেখি নয়ন মুদি’ শিরোনামে এ সংগীতসন্ধ্যার সাক্ষী থাকলেন মিলনায়তনভর্তি দর্শক। পরদিন রোববার থেকে মঙ্গলবার টানা তিন দিন বাউলসংগীত কর্মশালা পরিচালনা করেন তিনি। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কর্মশালায় শিল্পকলা একাডেমির সংগীতশিল্পী, বাউলশিল্পীসহ প্রতিশ্রুতিশীল ৪২ জন শিল্পীর সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। প্রশিক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলেন। বলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালো লাগার কথা।
গল্পে গল্পে পার্বতী জানালেন প্রকৌশলী বাবা আর মা চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। রাউজানের পশ্চিম গুজরার গ্রামের পারিয়ালপাড়ায়। দেশভাগের পর তাঁরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। বাবার চাকরির কারণে নানান জায়গায় থাকা হলেও শৈশবের উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে আসাম ও কোচবিহারে। তিনি বলেন, ‘সত্তরের দশকে আমার জন্ম। আসামে বাঙালি বিতাড়নের আন্দোলনের সময়ে বাবা আমাদের নিয়ে আসেন কোচবিহারে। সেখানেই আমরা বড় হই। আমরা এক ভাই, তিন বোন।’
বাবা-মা দুজনই সংগীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন। পার্বতীর হাতেখড়ি হয় উচ্চাঙ্গসংগীত ও কত্থক নৃত্যে। শৈশবেই। ১৬ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। মজার বিষয় হচ্ছে, শান্তিনিকেতনে আসার আগে কখনো বাউলের সংস্পর্শে আসেননি তিনি। ছোটবেলায় রেকর্ডে পূর্ণদাস বাউলের গান শোনা—এটুকুই।
পার্বতীর স্মৃতির কড়া নাড়তে গিয়ে শোনা গেল শান্তিনিকেতনগামী ট্রেনের ঝিকঝিক—‘ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলাম। ট্রেনে আমাদের কামরায় উঠলেন এক অন্ধ বাউল। গান শুরুর আগে তিনি একতারায় টুং একটা আওয়াজ করলেন। সেই আওয়াজ আমার ভেতরে একটা কেমন যেন অনুভূতি জাগাল। মনে হলো, আরে এটা তো আমার আওয়াজ! ট্রেনে কত লোক ওঠা–নামা করছে, চা, বাদাম বিক্রি হচ্ছে। সেসব তো কানে ঢুকছে না। আমি শুনছি, সেই অন্ধ বাউল গাইছেন। গানটার অর্থ বুঝতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু তাঁর একতারার আওয়াজ আমার গভীর থেকে গভীরে ছুঁয়ে দিয়েছিল।’
পার্বতী ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। পাঠক্রমের অংশ হিসেবে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের দিকে। কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাউলদের ছবি আঁকা। খুব আনন্দ দিয়ে আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়াতেন সহপাঠীদের নিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে পার্বতী মনে প্রশ্ন আসে, বাউলেরা এত ভালো মানুষ হয় কী করে? মনে হয়, বাউলেরা কত সহজ, কত গভীর, কত নিরহংকার! এ শুধু গান নয়, একটা দর্শন, ভাব। সেই ভাবের মধ্যেই থাকেন বাউলরা।
একদিন পরিচয় হলো ফুলমালা দাসীর সঙ্গে। তিনি কলাভবনে আসতেন। তাঁর কাছে পার্বতীর আবদার, ‘গান শিখব।’ ফুলমালা নারাজ। আকুতি–মিনতির একপর্যায়ে রাজি হলেন এক শর্তে—ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে হবে, পার্বতীকে সঙ্গে থাকতে হবে। তা-ই হলো। ট্রেনে ভিক্ষা করতে করতে পার্বতী গান শিখলেন। কলাভবনের ক্লাস শেষ করে ফুলমালা দাসীর সঙ্গে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরতেন। গান করতেন, ভিক্ষা করতেন। বিশ্বভারতীর সহপাঠীরা এসব ট্রেনেই আসতেন। তাঁদের কাছেও গান শুনিয়ে ভিক্ষা চাইতেন তিনি। বন্ধুরা তো ভেবেই নিল, পার্বতী দাসের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কলাভবনের শিক্ষার্থীর গান গেয়ে ট্রেনে ভিক্ষা—এটা কেউই সহজভাবে নিতে পারেনি।
’৯৪ সালের দিকের কথা। একদিন সনাতন দাস বাউল এলেন কলাভবনের চাতালে। পৌষ মেলায়। তাঁকে দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছেন পার্বতী। শিষ্য গুরু পেয়ে গেলেন, গুরু শিষ্যকে গ্রহণ করলেন। কলাভবন ছেড়ে পার্বতীর গন্তব্য বাঁকুড়ার সোনামুখী। সনাতন দাসের আশ্রম। প্রায় সাত বছর সনাতন দাস বাউলের সঙ্গে দেশ-দেশান্তরে, আশ্রমে আশ্রমে গান করেন গুরু-শিষ্য। কখনো গুরুর সঙ্গে সুর তুলেছেন, কখনো দিয়েছেন তাল, নেচে–গেয়ে মাতিয়েছেন আসর। একসময় গুরুর পরামর্শে পার্বতী চলে যান কর্ণাটকের হাম্পিতে, এক সাধকের কাছে। সেখান থেকে কেরালায়। এখানে দেখা হলো আধ্যাত্মিক গুরু আবদুস সালামের সঙ্গে। তাঁর কাছে দীক্ষা নেন পার্বতী। ২০০৭ সালে গুরু আবদুস সালাম মারা যান। এর আগে অবশ্য গুরুর নির্দেশে পার্বতী ১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন কেরালার রবি গোপাল নায়ারকে।
একটা বিষয় জানার খুব আগ্রহ। পার্বতীর কাছে জানতে চাই, তাঁর অভিনব পরিবেশনার রহস্য। মঞ্চে নেচে নেচে অনুষ্ঠান করেন, তখন একটা অদ্ভুত আবহ তৈরি হয়। জানালেন, গুরু সনাতন দাস এভাবেই গান গাইতেন। তিনি সেই ধারাই অনুসরণ করেন। যোগ করলেন, বাউল নাচের একটা পদ্ধতি আছে। বৈষ্ণব সাধকদের নাচের ধারাটাই সনাতন দাসেরা বহন করেছেন। তবে বাউল নাচের একটা বিজ্ঞান আছে। পা ফেলার সঙ্গে প্রতিটি তালের সঙ্গে শ্বাস–প্রশ্বাসের সম্পর্ক আছে। কোরিওগ্রাফি নয়, বাউলের নাচ হলো ভাবের।
জানতে চেয়েছিলাম শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর কাছে, হঠাৎ কেন পার্বতী দাসকে নিয়ে এত আয়োজন। তিনি বলেন, ২০১০ সালে আমাদের বাউলসংগীত পেয়েছে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। শিল্পকলা একাডেমি বাউলসংগীতের প্রচার ও প্রসারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে এ আয়োজন।