গল্পগুলো বাক্সের বাইরে বেরোচ্ছে না

এমরানের দুই সহশিল্পী সোবিতা ও ভিনিত। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
এমরানের দুই সহশিল্পী সোবিতা ও ভিনিত। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

এক দিনেই দেখা হয়ে গেল ‘বার্ড অব ব্লাড’। নেটফ্লিক্সের নতুন ভারতীয় প্রযোজনা। সাত পর্বের এই ধারাবাহিকটি মুক্তির আগেই যে হইহই–রইরই আওয়াজ তুলেছিল, তা দেখে আর তর সইছিল না। অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক তো বটেই, কোমরে কাছা দিয়ে এই সিরিজের প্রচারে নেমেছিলেন ওয়েব সিরিজটির এক অংশের প্রযোজক শাহরুখ খান। কিন্তু এত আওয়াজের যে ভার, তা ঠিক ‘বার্ড অব ব্লাড’ বহন করতে পারল না। মনে লেগেও যেন লাগল না ভালো লাগার তিরটা। এমরান হাশমি খুব চেষ্টা করেছেন, নিজের পরিণত অভিনয় দিয়ে মন ছুঁয়েও গেছেন, কিন্তু বিপত্তিটা মূলত গল্পের একঘেয়েমিতেই ছিল।

গল্পটা খুব চেনা

সাত পর্বের এ ধারাবাহিকটি নেটফ্লিক্সে একটানা দেখার জন্য আপনাকে দিনের প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করতে হবে। সিরিজটির গল্প নেওয়া হয়েছে ভারতীয় লেখক বিলাল সিদ্দিকীর উপন্যাস বার্ড অব ব্লাড অবলম্বনে। বাঙালি নির্মাতা রিভু দাশগুপ্ত সিরিজটির পরিচালক। গল্প মূলত একজন ভারতীয় গুপ্তচরের। সেই গুপ্তচর ঢুকে পড়ে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে। তার ভেতর জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। সে একের পর এক দুর্ধর্ষ ও রক্তক্ষয়ী অপারেশন করে যাচ্ছে। তার সামনে হেরে যাচ্ছে শত্রুপক্ষের সেনারা, ভয়ংকর জঙ্গিরা। কী, গল্পটা চেনা চেনা লাগছে? হ্যাঁ, ‘বার্ড অব ব্লাড’ দেখতে আমারও হঠাৎ মনে পড়ে গেছে সাইফ–ক্যাটরিনার ছবি ফ্যান্টম–এর কথা। আবার কোথাও গিয়ে ফ্রেম দেখে মনে হয়েছে, দেখছি সালমান খানের এক থা টাইগার কিংবা টাইগার জিন্দা হ্যায়। কোথাও গিয়ে সিরিজটি মিলে গেছে সাইফেরই আরেক ছবি এজেন্ট বিনোদ–এর সঙ্গে। কোথাও আবার জন আব্রাহামের কাবুল এক্সপ্রেস–এর সঙ্গে পাওয়া গেছে এর মিল! আসলে হয়েছে কি, সিরিজটির গল্পই সেই গৎবাঁধা ধারাতেই সাজানো। একজন ভারতীয় গুপ্তচর থাকবে, যিনি প্রতিবেশী দেশে গিয়ে শত্রুদের হারিয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে। আর এই যাত্রায় সেই গুপ্তচর হারাবে কাছের কিছু মানুষকে। ওপরে বলা সবকটি বলিউড ছবিতেই এমন স্বাদ পেয়েছেন দর্শক। এবার আবারও নেটফ্লিক্সের ‘বার্ড অব ব্লাড’–এ পাওয়া যাবে সেই স্বাদ।

জোর ছিল কীর্তির অভিনয়ে

নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার জন্য...

ভারতীয় প্রযোজনার দিকে নেটফ্লিক্স যে বিশেষ নজর দিচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ পর্যন্ত বেশ কিছু বড় কাজ করেছে নেটফ্লিক্সের ভারত অংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি প্রযোজনার নাম ‘সেকরেড গেমস’। এরই মধ্যে এর দুটি সিজন মুক্তি পেয়ে গেছে। দুটিই বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। মাঝে একটি তিন পর্বের ভারতীয় সিরিজও এসেছিল নেটফ্লিক্সে, নাম ‘ঘুল’। ‘বার্ড অব ব্লাড’ দেখতে গিয়ে আবারও সেই দুই প্রযোজনার কথা মনে পড়ে যেতে পারে দর্শকের। কারণ আগের দুই প্রযোজনার নেটফ্লিক্সের এবারের কাজটিও সেই ধর্ম, জাতিগত রেষারেষি আর রাজনীতির ওপর ভর করে এগিয়ে গেছে। ভারত–পাকিস্তান আর হিন্দু–মুসলিমের বিভক্তি থেকে যেন বেরিয়ে আসতে পারছে না নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া। ভারতীয়, তথা উপমহাদেশের দর্শকদের জন্য ভারত–পাকিস্তান ইস্যুকে ‘হট কেক’—এটা যেন খুব বুঝে গেছে মার্কিন এই স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম। তাই তো হলিউডের ছবিতে যেমন একটা কুচক্রী রুশ গুপ্তচর বা খল চরিত্র থাকবেই, তেমনই এখন নেটফ্লিক্সের ভারতীয় প্রযোজনাগুলোয় মৌলবাদ আর উগ্রপন্থী থাকবেই, থাকবে ভারত–পাকিস্তান ইস্যু।

‘বার্ড অব ব্লাড’–এ এমরান হাশমি

এমরান হাশমির চেষ্টা

পুরো ওয়েব সিরিজে তিনজন শিল্পীর অভিনয়ের কথা বলতে হয় আলাদা করে। প্রথমত এমরান হাশমি। তিনি চেষ্টা করছেন সাইফ, সালমান, জন আব্রাহামের মতো ‘সুদর্শন’ গুপ্তচর না হয়ে একটু স্বাভাবিক থাকার, সেদিক থেকে সফলও হয়েছেন। কিন্তু তাঁর সহশিল্পীরা ঠিক তাঁর সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। অভিনেত্রী ও মডেল সোভিতা ধুপিলাল ওয়েব সিরিজ ‘মেইড ইন হেভেন’–এ যতটা ভালো অভিনয় করেছিলেন, এবারের সিরিজের হয়েছে ঠিক এর উল্টো। এমরান হাশমির আরেক সহশিল্পী ভিনিত কুমার সিংয়ের বেলায়ও তা–ই হয়েছে। অনুরাগ কাশ্যপের মুক্কাবাজ–এর মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন ভিনিত। সংক্ষিপ্ত চরিত্রের অভিনয় করেছেন গ্যাংস অব ওয়াসিপুর–ছবিতেও। কিন্তু এই ওয়েব সিরিজে এসে ‘বীর সিং’ চরিত্রে সেই অভিনয়ের জাদু ছড়াতে পারেননি। তবে অভিনয়ের দিক থেকে পিংক ছবির অভিনেত্রী কীর্তি কুলহারি ও পাকিস্তানি গুপ্তচর তানভির শেহজাদ চরিত্রে জয়দ্বীপ আহ্লাওয়াত পাল্লা দিয়েছেন এমরানের সঙ্গে। বিশেষ করে কীর্তি তাঁর শেষ দৃশ্যে মনে দাগ কেটেছেন। অভিনয়টা ঠিক কমও করেননি, আবার বেশিও না, এক্কেবারে পরিমিত।

শেষ কথা

শাহরুখ ও গৌরী খান রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্টের ব্যানারে ‘বার্ড অব ব্লাড’ তৈরি করেছেন। আর এর প্রচারস্বত্ব কিনে নিয়েছে নেটফ্লিক্স। এর আগেও বারবার প্রতিটি প্রযোজনায় রাধিকা আপ্তেকে নেওয়ার কারণে ‘একঘেয়েমির’ দোষে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল এই স্ট্রিমিং সাইটের ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের। এবার গল্পের বেলায় আবার পুরোনো অভিযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে যাচ্ছে। তবে ভারতীয়দের জন্য গল্পের শেষে নিজ দেশের জয় দেখা বরাবরই আনন্দের, সেটা যত অবাস্তবই হোক না কেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে বারবার এমন একঘেয়েমি কতটা সহ্য করার মতো হবে, তা–ই এখন ভাবার বিষয়।