খুঁড়িয়ে চলছে মিলনায়তনটি

২০০৮ সালে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি হয়। ছবি: সুমন ইউসুফ
২০০৮ সালে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি হয়। ছবি: সুমন ইউসুফ

ম্যুরালে আঁকা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের মুখটি হাস্যোজ্জ্বল। তবে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় অবস্থিত তাঁর নামাঙ্কিত মিলনায়তনটির চেহারা বেজায় মলিন। জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এখন বলতে গেলে খালিই পড়ে থাকে। প্রতি মাসে হাতে গোনা কয়েকটি নাটকের প্রদর্শনী করে মিলনায়তনটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে স্থানীয় নাট্যদলগুলো। অবকাঠামোগত উন্নয়নও নেই তেমন একটা।

২০০৮ সালে এই মিলনায়তনটি তৈরি হয়। পুরান ঢাকার মানুষের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হতে পারত এটি। প্রথমে বেশ আগ্রহ দেখা গিয়েছিল মিলনায়তনটিকে ঘিরে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে। এখন মিলনায়তনটিতে অনুষ্ঠান থাকে না বললেই চলে। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত মিলনায়তনটিতে নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে মাত্র ৩০ টি। এর মধ্যে গত বছরের জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং এ বছরের মে ও জুন মাসে, অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে পাঁচ মাসই কোনো নাটকের প্রদর্শনীই হয়নি সেখানে। হাতে গোনা যে কটি নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে, তার সবই স্থানীয় নাট্যদলগুলোর।

স্থানীয় নাট্যদলগুলোর নির্দেশকদের একটি মোর্চা বাংলাদেশ নাট্য নির্দেশক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোকন রানা বলেন, ‘মিলনায়তনটি এখানকার নাটকের কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখানে আমরা নিয়মিত নাটক প্রদর্শনী করি। তবে সাউন্ড, লাইটসহ আরও কিছু কাঠামোগত অসুবিধা আছে। এগুলোর সংস্কার হলে ভালোভাবে কাজ করা যাবে।’

প্রথম দিকে মিলনায়তনটিকে ঘিরে বেশ উৎসাহ দেখায় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। বেশ কয়েকটি নাট্যদল তাদের নাটকের প্রদর্শনী ও উৎসবও আয়োজন করে এখানে। কিন্তু দিন দিন এই উৎসাহ কমে যায়। মিলনায়তন সূত্র জানায়, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনভুক্ত নাটকের দলের শেষ প্রদর্শনী ছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর এই বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে আর কোনো প্রদর্শনী তারা করেনি। যদিও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও নাটকের দলগুলোর মধ্যে হরহামেশাই মঞ্চসংকটের অজুহাত শোনা যায়। এমনকি এখানে ফেডারেশনের নাটকের দলগুলোর জন্য ভাড়াও কমিয়ে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের জন্য ভ্যাটসহ মিলনায়তন ভাড়া ৮ হাজার ৫০ টাকা। অন্যদিকে ফেডারেশনের বাইরে মিলনায়তনের ভাড়া ৯ হাজার ২০০ টাকা। অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য ১৩ হাজার ৮০০ টাকা। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনভুক্ত নাটকের দলগুলোর আগ্রহ নেই কেন? এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘প্রথমত, ওই মিলনায়তনটির সমস্যা হলো ওটা শহরের একটা পাশে পড়ে গেছে। তা ছাড়া ওটা একটা বাণিজ্যিক এলাকা। ওখানে সন্ধ্যা সাতটায় প্রদর্শনী শুরু করা যায় না। লোকজনের ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ হলে রাত আটটার দিকে শো শুরু করতে হয়। তা ছাড়া শিল্পকলা একাডেমির মতো নাটক দেখার সংস্কৃতিও ওখানে নেই। যার কারণে মাইকিং করে কিংবা লিফলেট বিতরণ করে বিশাল একটা প্রচার না করলে দর্শক পাওয়া যায় না। সে কারণে নিয়মিত একটা দলের ওই জায়গায় প্রদর্শনী করাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া অবকাঠামোগত সংস্কারও দরকার। এই নানা কারণে ফেডারেশনের নাটকের দলগুলো সেখানে নিয়মিত প্রদর্শনী করতে পারেনি। তবে আমরা আবার মেয়র উৎসবের মাধ্যমে ওখানে প্রদর্শনী শুরু করার পরিকল্পনা করছি এবং কীভাবে ওখানে নিয়মিত নাটক প্রদর্শনী করা যায়, সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা করছি।’

পুরান ঢাকায় এই মিলনায়তনটি সংস্কৃতিচর্চার একটি কেন্দ্র হতে পারত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদাসীনতায় নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে মিলনায়তনটি। সরেজমিনে দেখা যায়, মিলনায়তনের ১৮টি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মধ্যে মাত্র ছয়টি সচল। এর তত্ত্বাবধায়ক অমরেশ মণ্ডল বলেন, মিলনায়তনটিতে শীতাতপযন্ত্র না থাকার কারণে এখানে বড় কোনো প্রদর্শনী বা সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করা যাচ্ছে না। লাইট, সাউন্ড ও অন্যান্য সরঞ্জামের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। স্থানীয় নাট্যসংগঠনগুলোও লাইট ও সাউন্ড পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ করেছে। অমরেশ আরও বলেন, ‘লাইট ও সাউন্ড বাইরে থেকে ভাড়ায় আনা যায়। কিন্তু শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তো আর আনা যায় না। আর সেটি না থাকলে মিলনায়তনে কাজ করাটা কঠিন। আগে বিভিন্ন চ্যানেলের কাজ হতো। গত রোজার সময় সেটিও করা যায়নি।’

মিলনায়তনের নিচতলায় আছে একটি লাইব্রেরি। সেখানে পর্যাপ্ত বই নেই। থাকে না খবরের কোনো কাগজও। অমরেশ মণ্ডল বলেন, ‘এখানে বই নেই বললেই চলে। যা আছে তার বেশির ভাগই ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করা। তা ছাড়া এখানে কোনো দৈনিক পত্রিকা রাখা হয় না। অন্ততপক্ষে পাঁচটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা থাকা দরকার।’ মিলনায়তনের তত্ত্বাবধায়ক জানান, তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ কয়েকবার আবেদন করেছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (অঞ্চল-৫) সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের তিন বছরের একটি পরিকল্পনা আছে। আমরা এগোচ্ছি। আস্তে আস্তে সব সংস্কার করা হবে। মানুষ যাতে সেবা পায়, তার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ কত দিনের মধ্যে করা হবে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা একেকটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠাচ্ছি। প্রশাসনিকভাবে অনুমোদন হয়ে গেলেই কাজ শুরু হবে।’

রাজধানীজুড়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বেশ কতগুলো কমিউনিটি সেন্টার আছে। গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চ ও জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও এই কমিউনিটি সেন্টারের নিয়মকানুনের আওতায় রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আলাদা করে এই দুটি নাট্যমঞ্চ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এমনটি জানাল জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের এক সূত্র। এ কারণে ঠিক সাংস্কৃতিক একটি মিলনায়তন যেভাবে পরিচালনা হওয়া দরকার, সেভাবে এটি পরিচালিত হচ্ছে না।

রাজধানীর গুলিস্তানের বশির আহমেদ মিলনায়তন পরিচিত মহানগর নাট্যমঞ্চ নামে। সেখানেও নাটক মঞ্চায়ন হয় না বললেই চলে। বরং সেখানে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বেশি হয়। জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও এই পথে যাচ্ছে কি না, এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ নাট্য নির্দেশক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোকন রানা এ বিষয়ে অভিযোগ করে বলেন, ‘আসলে এটি মিলনায়তন হিসেবে চালানো হচ্ছে না। কমিউনিটি সেন্টারগুলো যে আদলে চলে, এটাকে সেভাবে চালাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কমিউনিটি সেন্টারে যে নিয়মগুলো সেই নিয়মের মাধ্যমে চলছে। ভাড়াও কমিউনিটি সেন্টারের আদলে নির্ধারণ করা হয়েছে, যার কারণে ঠিক মিলনায়তনের মতো এটি চলছে না।’