কাহিনি বাস্তবানুগ হওয়া চাই

ক্যাপ্টেন খান ছবির দৃশ্যে শাকিব খান ও বুবলী
ক্যাপ্টেন খান ছবির দৃশ্যে শাকিব খান ও বুবলী
>পবিত্র ঈদুল আজহার উৎসবে মুক্তি পেয়েছিল চারটি ছবি—ক্যাপ্টেন খান, মনে রেখো, জান্নাত ও বেপরোয়া। বরাবরের মতো এবারও আনন্দ থেকে ছবিগুলোর সমালোচনা ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ ছাপা হলো ক্যাপ্টেন খান ও মনে রেখোর সমালোচনা। আগামী সংখ্যায় বাকি দুটির সমালোচনা ছাপা হবে।

ক্যাপ্টেন খান
পরিচালক: ওয়াজেদ আলী, অভিনয়: শাকিব খান, বুবলী, মিশা সওদাগর, পায়েল মুখার্জি।
প্রযোজনা: শাপলা মিডিয়া

নাম্বার ওয়ান শাকিব খান, কিং খান, নবাব, বস নাম্বার ওয়ান, ডন নাম্বার ওয়ান ইত্যাদির পর এল চলচ্চিত্র ক্যাপ্টেন খান। দেড় দশক ধরে এসব কিং, নবাব, বস, ডন, ক্যাপ্টেন কিংবা খান সাহেব হলেন একজনই, ঢাকাই চলচ্চিত্রের সুপারস্টার শাকিব খান। অবশ্য ঈদুল আজহার ছবি ক্যাপ্টেন খান-এর শাকিব খান আসল নন, নকলও বলা যাবে না, ক্লোনমাত্র। তামিল ছবি আনজান (২০১৪)-এর রিমেক করেছেন ওয়াজেদ আলী। গত বছরের ঈদে শাকিব খানকে নিয়ে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নবাব বানিয়েছিলেন কলকাতার পরিচালক জয়দীপ মুখার্জি। অবশ্য সেটি ছিল হিন্দি ছবি বাদশাহ, বাজি ও সারফারোশ-এর ককটেল। এরপরও ছবিটি একটা হাইপ তৈরি করতে পেরেছিল, ভালোই ব্যবসা করেছিল দুই বাংলায়। জয়দীপ বাবু জোড়াতালিতে ওস্তাদ, প্রমাণিত হয়েছিল। ওয়াজেদ সাহেবের কাজ ছিল সে তুলনায় সহজ। কাহিনি নিয়ে কাতরতা নয়, আনজান ছবির শট টু শট অনুসরণ করে দৃশ্য গড়ে তোলার দায়িত্বই ছিল তাঁর। সামান্য কিছু পরিবর্তন তিনি করেছেন, যেমন কন্যাকুমারী হয়েছে চট্টগ্রাম আর মুম্বাই হয়েছে ঢাকা, মন্দির হয়েছে মাজার, রাজু ভাই হয়েছে ক্যাপ্টেন খান ইত্যাদি। তবে যথেষ্ট চালচ্চিত্রিক জ্ঞান ছাড়া প্রতিলিপিও ভালো দাঁড়ায় না। সেই নকলনবিশির দায়িত্ব পালনে তিনি অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন, আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। সে আলাপে যাওয়ার আগে এ কথা বলে নেওয়া দরকার, খোদ তামিল কাহিনিতেই আছে নানান অসঙ্গতি ও গোঁজামিল। মূল চরিত্রে বেশি মাত্রায় মনোযোগ দেওয়ার কারণে অন্যান্য চরিত্র হয়ে পড়েছে গৌণ, রয়ে গেছে অবিকশিত। কাহিনিও অনেক ক্ষেত্রে হারিয়েছে তার দিশা। মূল চলচ্চিত্রটি ইউটিউবে নেড়েচেড়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

শাকিব খান ও মাহিয়া মাহি । এবার এই দুই তারকার ছবি ঈদ উৎসবে মুক্তি পেয়েছে

আসিফ নামের এক তরুণ (শাকিব খান) চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তার ভাই আন্ডারওয়ার্ল্ড লর্ড ক্যাপ্টেন খানকে (শাকিব খান) খুঁজতে থাকে। বিভিন্ন সূত্রে সে জানতে পারে, তার ভাই মারা গেছে এবং খোঁজ করতে করতে ভাইয়ের হত্যাকারীদের কাছাকাছি সে পৌঁছে যায়। পরে বোঝা যায়, প্রতিপক্ষের হাতে কথিত নিহত ক্যাপ্টেন মোটেও মারা যায়নি, বরং আসিফ নামের ব্যক্তিই ক্যাপ্টেন খান, সে আসলে ছদ্মবেশে তার বন্ধু-সহকর্মী জয়ের (সম্রাট) হত্যাকারীকে খুঁজছে। এই হত্যাকারী হলো ক্যাপ্টেন-জয়ের চেয়েও বড় লর্ড ইব্রাহিম (মিশা সওদাগর)। ইব্রাহিম একবার পরিচয়পর্বেই এই দুই উঠতি লর্ডকে অপমান করেছিল। ক্যাপ্টেন তাই ইব্রাহিমকে উঠিয়ে নিয়ে এসে বেঁধে রেখে আরও বেশি অপমান করে। বদলা হিসেবে ইব্রাহিম জয়কে নিজ হাতে খুন করে, আর ক্যাপ্টেনের লোককে হাত করে তাদেরই একজনকে দিয়ে ক্যাপ্টেনকে গুলি করায়। কিন্তু যেহেতু ক্যাপ্টেন কখন বাঁচবে আর কখন মরবে, সেই সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিয়ে থাকে, তাই বেশ কয়েকটি গুলি খাওয়ার পরও কোনো এক জাদুবলে ক্যাপ্টেন বেঁচে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিমকে হত্যা করে বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেয়। এখন এই ক্যাপ্টেনের জীবন তো রোমান্সবিহীন যেতে পারে না; তথ্য হিসেবে জানিয়ে রাখা যায়, তার প্রেম হয়েছিল শহরের পুলিশ কমিশনারের (আশিস বিদ্যার্থী) মেয়ে রিয়ার (শবনম বুবলি) সঙ্গে। তারা একসঙ্গে দুটি গান গায়, অল্প কিছু প্রেমের দৃশ্যেও অংশ নেয়।

আগেই বলেছি, কাহিনিতে রয়েছে নানান অসঙ্গতি আর তা বাস্তবতাবিবর্জিতও। ক্যাপ্টেন চরিত্রের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়ার কারণে অন্যান্য চরিত্রও অবিকশিত থেকে গেছে, যেমন পুলিশ কমিশনার চরিত্রটি। তিনি কাহিনিতে প্রবেশ করেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকজনকে ধরে বেশ সাড়া ফেলেন। কিন্তু তাঁর মেয়ের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের প্রেম হওয়ার পর তিনি যেন অবসর নিয়ে নিলেন। পুলিশের মেয়ে প্রেম করছে চোরের সঙ্গে! পুলিশ-মেয়ে-চোর—এই তিন পক্ষের যে একটা দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং তারপর সমঝোতা দরকার ছিল, তা বাকিই রয়ে গেল। ইব্রাহিম যে জয়কে হত্যা করল এবং ক্যাপ্টেনকে গুলি করল, আবার পাল্টা প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ক্যাপ্টেন যে ছোট ছোট গ্যাংস্টার থেকে শেষে ইব্রাহিমকে পর্যন্ত হত্যা করল, এত হত্যা-গোলাগুলি-মারামারির মধ্যে আমরা একবারের জন্যও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেখলাম না। বাংলা ছবির চিরাচরিত প্রথা অনুসারে শেষ দৃশ্যেও দেখলাম না কোনো পুলিশের উপস্থিতি। ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’—এই আপ্তবাক্য বলার মতোও কাউকে পাঠানো হলো না। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে, এ এমন এক অবাস্তব জগৎ, যেখানে আইন-আদালত নেই, যেখানে নিরুদ্বিগ্ন মানুষ পিস্তল দিয়ে যখন-তখন যে কাউকে খুন করে। এ এমন এক বিশৃঙ্খল ভৌগোলিক সমাবেশ, চরিত্রগুলো কখন ঢাকার হাতিরঝিলে, কখন ব্যাংককে আর কখন কক্সবাজারের ফাইভ স্টার হোটেলে ঘোরাঘুরি করবে, তা বুঝতে দর্শককে হয়রান হতে হবে।

বড় চরিত্রে শাকিব খান বা মিশা সওদাগর বরাবরের মতোই ভালো অভিনয় করেছেন। সম্রাটও খারাপ করেননি। তবে বুবলি বিশেষভাবে ভালো ছিলেন। দৃশ্যায়োজনের সাজেশন যেহেতু তামিল ছবিটিতেই ছিল, ফলে চিত্রগ্রহণের কাজটিও মন্দ হয়নি। তবে সম্পাদনায় রয়ে গেছে ব্যাপক সমস্যা। ক্যাপ্টেন ও রিয়ার পরিচয় আর প্রেম জমে ওঠার পর্বটি টানা রেখে দেওয়া ঠিক হয়নি। দুজনের ভৌগোলিক যুক্ততায় কোনো সাদৃশ্য না থাকলেও তাদের বারবার, যখন-তখন, যত্রতত্র দেখা হয়েছে। এক দৃশ্যে দেখা গেল ক্যাপ্টেন ফ্লাইওভার দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে, আর পরের দৃশ্যে দেখা গেল রিয়া ক্যাপ্টেনকে পেছন থেকে ডাক দিচ্ছে, আর ক্যাপ্টেনের গাড়ি ফ্লাইওভারে নয়, সমতলে থামছে। চলচ্চিত্রটির কণ্ঠসংগীত ও আবহসংগীত—কোনোটিই মনোগ্রাহী হয়ে ওঠেনি।

ফর্মুলার ছবিতে আইটেম গান থাকে, প্রেমের গান থাকে, তা থাকুক। এ ছবিতে তা আছেও। কিন্তু কাহিনি যত বেশি বাস্তবতাবিবর্জিত হবে, চলচ্চিত্রটি তত কম গ্রহণযোগ্য হবে। শাকিব খান দিয়েও সে ক্ষেত্রে পার পাওয়া যাবে না। চিত্রনাট্য রচনার সময় কিংবা রিমেকের জন্য কাহিনি নির্বাচনের সময় বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়