অন্য বাচ্চাদের মতো তিনিও ভালোবাসতেন সিনেমা। অন্য বাবা-মায়ের মতো তাঁর বাবা-মাও চেয়েছেন, তাঁদের সন্তান ভালো কিছু করুক। কিন্তু তাঁর ভালো লাগাটা একটু বেশিই ছিল। আর তাই ভালো লাগার বিষয় থেকেই ভালো কিছু করছেন তিনি। ভালো বললে কম বলা হবে। এতটা ভালো, যতটা ভালো হলে কান চলচ্চিত্র উৎসবের কর্তৃপক্ষও তাঁর বিচারক হওয়ার আবেদনকে ‘না’ করতে পারেনি।
তিনি সাদিয়া খালিদ রীতি। পড়েছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, মার্কেটিং অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে। এরপর বাবা-মায়ের আশা পূরণ করে কিছুদিন দেশের এক ব্যাংকের জনসংযোগ ব্যবস্থাপক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর একদিন মনে হলো, অনেক তো হলো, এবার নিজের ইচ্ছা আর স্বপ্নকে নিয়ে বাঁচা যাক। যেই ভাবা, সেই কাজ। আবেদন করেন চলচ্চিত্র শেখার বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় (ইউসিএলএ)। কথায় বলে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। ফিরতি মেইল আসে। ইউসিএলএর ‘স্কুল অব থিয়েটার, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন’-এ এক বছরের ডিপ্লোমা প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পান। রীতির মা মারা যান ২০০৭ সালে। তাই তখন স্বপ্নকে সত্যি করতে পাশে এসে দাঁড়ান বাবা। মেয়ের স্বপ্নের যাত্রায় জানান, সমর্থন আছে তাঁর। ব্যস, আর কী লাগে! যে জীবন চেয়েছিলেন, সেই জীবন পেয়ে যান সেখানে। পড়াশোনা শেষ করে ‘ওয়ার্ক পারমিট’ নিয়ে দুই বছর হলিউডে কাজ করেন। তারপর ফিরে আসেন বাবা-মায়ের কাছে।
দেশে এসে যে কত কিছু করেছেন তিনি। সেই তালিকা এত লম্বা, তা কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে ফিপরেস্কির বিচারক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ফিপরেস্কি শুনেই কেমন পরিচিত লাগল, তা–ই না? মনে হলো, আগে কোথায় যেন শুনেছেন। হ্যাঁ, ২০০২ সালে কান উৎসবে ফিপরেস্কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে প্রয়াত চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। আর এটিই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন। সাদিয়া খালিদ রীতি এখন সেই পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্য। তাঁর সঙ্গে আরও থাকবেন ফ্রান্সের দুজন, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম আর ইসরায়েলের একজন করে বিচারক।
আটটি দেশ থেকে প্রতিনিধিত্ব করা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকসের এই নয় বিচারককে তিনটি দলে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি দল প্রতিযোগিতা বিভাগ, আঁ সার্তে রিগার এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইক বিভাগ থেকে একটি করে ‘সমালোচকের দৃষ্টিতে সেরা ছবি’ বাছাই করবেন। আর এর জন্য তাঁদের দেখতে হবে নির্বাচিত ৩৫টি সিনেমা।
কানের ছবিগুলোকে আয়োজকদের পাশাপাশি মুক্ত কয়েকটি সংগঠনও পুরস্কার দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফিপরেস্কি। এর আগে কানের এই বিভাগে বিচারক হওয়ার দুর্লভ সম্মান অর্জন করেন ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ফিপরেস্কির বিচারক হন। এরপর ২০০৫ ও ২০০৯ সালে তিনি এই গুরুদায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান। ১০ বছর পর আবারও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে কানে বিচারক হিসেবে যাচ্ছেন সাদিয়া খালিদ রীতি। এই লেখার জন্য যখন তাঁকে ফোন করা হয়, ততক্ষণে কেটে গেছে সব আশঙ্কা। হাতে এসে গেছে ফ্রান্সের ভিসা। ১৩ মে উড়াল দেবেন ফ্রান্সের সমুদ্রপাড়ে, বিশ্বের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের আনন্দ নগরী কানের উদ্দেশে।
এর আগে সাদিয়া খালিদ রীতি আরও চারটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেগুলো হলো ইতালির ‘রিলিজিয়ন টুডে ফেস্টিভ্যাল’, ভারতের ‘শিলিগুড়ি শর্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টারি ফেস্টিভ্যাল’, নেপালের ‘হিউম্যান রাইটস ফেস্টিভ্যাল’ এবং এ বছর ১৬তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। যুক্তরাস্ট্রে যাওয়ার আগে কাজ করেছেন দ্য ডেইলি স্টার এ। লস এঞ্জেলসে কাজ করেছেন ব্রুইন (ডিবি), এএমবিআই মিডিয়া গ্রুপে। এর মধ্যে জেসিআই ঢাকা কসমোপলিটনের মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। এখন ঢাকা ট্রিবিউনের শোটাইম এডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন।
কানে বিচারক হিসেবে আবেদন করার সময় ভেবেছিলেন সত্যি সত্যিই আপনি নির্বাচিত হবেন? সাদিয়া খালিদ রীতি বললেন, ‘হ্যাঁ, ভেবেছিলাম। এবারই প্রথম আবেদন করেছি। কারণ আমি জানতাম, অল্প বয়সেই যাদের সিভি ভারী, কান কর্তৃপক্ষ তাঁদের অগ্রাধিকার দেয়। বয়সের সঙ্গে তো কত যোগ্যতা যুক্ত হয়। তখন প্রতিযোগী বেড়ে যায়। আমি যেহেতু মোটামুটি কাজ করেছি, তাই আশা ছিল।’
ফিপরোস্কিতে বিচারক হওয়াকে ‘ব্যক্তি অর্জন’ মনে করছেন না সাদিয়া খালিদ রীতি। তাঁর কাছে এটি জাতীয় অর্জন। বললেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে একটা সম্ভাবনার জোয়ার চলছে। আমাদের দেশে এখন এমন অনেক উদীয়মান চলচ্চিত্র নির্মাতা আছেন, যাঁরা নিজেদের কাজ দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁরা ভালোভাবে এবং নিয়মিত দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আশা করি এই যাত্রা অব্যাহত থাকবে।’