কাকে ভোট দেবেন তরুণ তারকারা?

ভোটার তালিকার হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে তরুণ ভোটারের সংখ্যা ২ কোটির মতো। ধারণা করা হচ্ছে, তরুণদের ভোটেই বদলে যেতে পারে অনেক কিছু। তাই তরুণ ভোটারদের রায় নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার জন্য প্রার্থীরাও প্রচারণায় তরুণদের নানা বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন। চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকে অনেক তরুণ কাজ করছেন। তাঁদের অনেকেই এবার প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যাচ্ছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে রয়েছে রোমাঞ্চকর সব ভাবনা। তরুণ তারকাদের ভোট ভাবনা নিয়ে কথা হলো কয়েকজনের সঙ্গে।

শবনম ফারিয়া
শবনম ফারিয়া

এ বছরের আলোচিত একটি সিনেমার নাম ‘দেবী’। ব্যবসায়িকভাবে সফল এই ছবিতে ‘নীলু’ চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে চমকে দেন শবনম ফারিয়া। অনেক দিন ধরে নাটক আর বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করলেও এটিই ছিল তাঁর প্রথম সিনেমা। তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় এই তারকা এবার প্রথম ভোটকেন্দ্রে যাবেন। যদিও গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোট দেওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি ভোট দিতে যেতে পারেননি। এবার সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর মধ্যে নানা ভাবনা কাজ করছে। কক্সবাজার থেকে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্বাচন নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা বললেন প্রথম আলোকে, ‘আমার এলাকা থেকে যে যোগ্য প্রার্থী, আমি তাঁকে ভোট দেব। কোনো মার্কা দেখে কাউকে ভোট দেব না।’

শবনম ফারিয়ার মতে, দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁর বাক্‌স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশে যেমন ভালো কাজ হচ্ছে, তেমনি দু-চারটা খারাপ কাজও হচ্ছে। ভালো-মন্দ আমাকে বলতে পারার স্বাধীনতা দিতে হবে। সমালোচনা করছি মানে এই নয় যে আমি বিরোধী পক্ষ। আমি সমালোচনা করছি মানে, আমি আরও ভালো চাই। সমালোচনা তাঁরই করব, যাঁর কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা বেশি। যেকোনো বিষয়ে সমালোচনা করলে তা সরকারকে ইতিবাচকভাবে নিতে হবে।’

৩০ ডিসেম্বর ভোটের পর নতুন করে সরকার গঠিত হবে। নতুন এই সরকারের কাছে শবনম ফারিয়ার প্রত্যাশা, ‘গত ১০ বছর যেসব কাজ হয়েছে, যেসব কাজ কোথাও অর্ধেক হয়ে আছে, সেগুলো অবশ্যই শেষ করা। যে দল পাস করুক, তাদের এটা করতেই হবে। প্রকল্পগুলো যেন বন্ধ না হয়ে যায়। আমি বড় হওয়ার পর দেখছি, ১০ বছর ধরে একটি সরকারই আছে। ছোটবেলায় দেখেছি, একটি সরকার বিদায় নিলে সেই সরকারের ভালো কাজ অর্ধেক হওয়ার পর বাকি কাজ নতুন সরকার তা বন্ধ করে দিত।’

ঢাকার বাসিন্দা শবনম ফারিয়া যানজটমুক্ত একটি শহরের প্রত্যাশা করেন নতুন সরকারের কাছে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যানজট মারাত্মক সমস্যা, এটা যেন সমাধান হয়। শহরে বিদ্যুতের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে যেন উন্নতি হয়।

কক্সবাজারের মতো এত সুন্দর সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর কোথাও দেখেননি শবনম ফারিয়া। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আমাদের। এটার আরও ব্র্যান্ডিং ও উন্নয়ন দরকার। রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কক্সবাজারকে বিশ্বের সামনে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে হবে। পর্যটন দিয়ে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। এত সুন্দর আমাদের দেশ, এটা যেন তুলে ধরা হয়। সদ্য সিনেমায় নাম লেখানো ফারিয়া দেশের প্রেক্ষাগৃহ সংকটের বিষয়টি এবার বেশ উপলব্ধি করেছেন। ‘দেবী’ সিনেমা নিয়ে কথা বলতে সারা দেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নতুন সরকারের কাছে শবনম ফারিয়ার প্রত্যাশা, চলচ্চিত্রকে যেহেতু শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, এর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। সারা দেশে যেন প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বাড়ানো হয়। নাটকে এখন অনেকে নিয়মিত কাজ করছেন, এই নাটকের ক্ষেত্রকেও যেন শিল্প ঘোষণা করা হয়।

টয়া

‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতা দিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন মুমতাহিনা টয়া। নাটক, বিজ্ঞাপনচিত্র, গানের ভিডিও এবং চলচ্চিত্র অনেক মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তিনিও এবার প্রথম ভোটকেন্দ্রে যাবেন। নির্বাচন নিয়ে এই তরুণ তারকার ভাবনা কী? টয়া বললেন, ‘যেভাবে আমাদের দেশটা চলছে, এভাবে চলা উচিত। আরও ভালো চললে তো আরও ভালো। তবে চাইব, নির্বাচনে সবাই যেন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পারেন।’

কাকে ভোট দেবেন? টয়া বললেন, ‘এটা বলে দেওয়া ঠিক হবে! ভোটকেন্দ্রে যাব, মনের মধ্যে যে প্রার্থীকে নিয়ে ভাবনা কাজ করছে, তাঁকেই ভোট দেব। নতুন সরকার যাঁরা গঠন করবেন, তাঁদের কাছে আমার চাওয়া, ডিজিটাল প্রযুক্তির দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়েছি। সামনে যেন আরও বেশি এগিয়ে যেতে পারি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা এখনো পিছিয়ে। নতুন সরকার আমাদের সেই ঘাটতিগুলো পূরণ করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি, ক্ষেত্র বিশেষে যেন ছাড়িয়েও যেতে পারি।’

সাবিলা নূর

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাবিলা নূরের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তিনি বাসার সামনে ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। খেলার ফাঁকে বললেন, ‘আমি চাই, প্রথমত দেশে যেন শান্তিমতো নির্বাচন হয়। নির্বাচনকে ঘিরে এমন কোনো কিছু যেন না ঘটে, যাতে দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। জনজীবনের অস্থিরতা যেন তৈরি না হয়। অনেকে ভাবছেন, ভোট দিয়ে আর কী হবে। আমি সবাইকে বলব, এই ভাবনা থেকে সরে আসেন। ভোট দিলে তো কোনো ক্ষতি নেই। আমার একটা ভোট অনেক মূল্যবান,দেশ গঠনের জন্য এই ভোট আমি কেন দেব না? দেশের কথা চিন্তা করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সবার ভোট দেওয়া উচিত।’

নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন? সাবিলা নূর বলেন, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাঁকে খুশি তাঁকে দেব। ভোট অনেক মূল্যবান, এই কথা চিন্তা করে আমার দৃষ্টিতে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেব।’

ভোট শেষে যে দল সরকার গঠন করবে তাদের কাছে সাবিলার কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। বললেন, ‘আমরা সবাই বাংলাদেশি। একটা দেশের সবার মত এক হবে না। মতের পার্থক্য ভুলে সবাই যাতে দেশের স্বার্থে কাজ করেন। দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস দমন ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়া যেন নতুন সরকারের মূল উদ্দেশ্য হয়। এ ছাড়া সারা বিশ্বে এখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটা বড় ইস্যু। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কথাও যেন নতুন সরকার গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়।’

শবনম ফারিয়া, মুমতাহিনা টয়া ও সাবিলা নূর কাকে ভোট দেবেন সে কথাটি সরাসরি না বললেও নতুন প্রজন্মের আরেক তারকা তৌসিফ মাহবুব কোনো রাখঢাক করলেন না। তরুণ প্রজন্মের এই অভিনেতা বললেন, এবার নির্বাচনে তাঁর কাছে সবচেয়ে ভালো অপশন নৌকা। তিনি তাঁর মূল্যবান ভোটটি নৌকায় দেবেন। তৌসিফ বলেন, ‘আমার ভোট আমি নৌকায় দেব।’

তৌসিফ মাহবুব

পাঁচ বছরের অভিনয়জীবন তৌসিফ মাহবুবের। এই সময় শুটিং ছাড়াও অনেক দেশে ঘুরতে যান তিনি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তৌসিফ বলেন, ‘অভিনয়ের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছি। শুরুর দিকে যখন দেশের বাইরে গিয়েছি, তখন একটা কথা প্রায়ই শুনতাম, বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এবার ডিসেম্বরে যখন ব্যাংকক যাই, তখন মনে হয়েছে, আমার দেশও কোনো অংশে কম নয়। মানি আর না মানি, কাজ তো এই সরকার করেছে। অনেক সমস্যা আছে, তারপরও আমরা গত ৫-৬ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছি, তা সত্যিই বিস্ময়কর।’

নতুন সরকারের কাছে তৌসিফের প্রত্যাশা হলো, তারা যেন চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের সুযোগ আছে, মেধা আর জনশক্তিও আছে, এসব কাজে লাগাতে পারলে ডিজিটালিতে আমরা বিশ্বে ১ নম্বর হতে পারব। আর আমার সেক্টর নিয়ে বলতে চাই, আমাদের দেশে আইফ্লিক্স, নেটফ্লিক্স এসেছে। সামনে আমাজান আসবে। এসব এখন আমরা শুধু দেখতে পারি, নিজেরা প্রোডাকশন বানাতে পারি না। কিন্তু আমাদের যোগ্যতা আছে, তারপরও কিছুই করতে পারি না। ভারত এরই মধ্যে অনেক কিছু করছে। আমার প্রত্যাশা এই সুযোগটা সরকার করে দেবে।’

ভাবনা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন এবারের প্রথম ভোটার হওয়া অভিনয়শিল্পী আশনা হাবিব ভাবনা। এবার নির্বাচনে প্রথম ভোট দিতে পারবেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁদের অনেকেই ভোটের ব্যাপারে আগ্রহী নন। তিনি মনে করেন, ভোট দিতে অবশ্যই যেতে হবে। কেননা প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার ও দায় এই তরুণদের। ভাবনা বলেন, ‘অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকেন। কিন্তু জন্মগতভাবে যে দেশের নাগরিক, একে অনেকে পাত্তা দেন না। কিন্তু এটা একটা বিরাট প্রাপ্তি। আর তরুণের প্রথম ভোটের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ভোটের মধ্য দিয়ে তাঁদের একধরনের অভিজ্ঞতা হবে, পাশাপাশি আগামী দিনের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে।’

কাকে ভোট দেবেন? ভোটার ভাবনা জানান, পুরান ঢাকার উন্নয়নে যিনি কাজ করবেন, সেখানকার মানুষের নির্বিঘ্ন যাতায়াত ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবেন, তাঁকেই ভোট দিতে চান ভাবনা। কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিচ্ছেন? তিনি বলেন, দেশকে ভালোবাসার জন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে হয় না। কেবল সচেতন একজন নাগরিক হলেই চলে।

বিনোদন অঙ্গনের অনেকেই তাঁদের সমর্থনের কথা সরাসরি প্রকাশ করেছেন। ভাবনা বলেন, ‘আমি একজন অভিনয়শিল্পী, একজন নৃত্যশিল্পী, একজন লেখক হতে চাই। আমি রাজনৈতিক দলের সমর্থন দেওয়ার যথাযথ লোক নই। যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁরা সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’

নতুন সরকারের কাছে ভাবনার প্রথম প্রত্যাশা মাদকমুক্ত যুবসমাজ। কারণ এই যুবকেরাই দেশের দায়িত্ব নেবেন। মাদকাসক্ত চালক যেমন যাত্রীর জীবনের জন্য হুমকি, তেমনি যেকোনো পেশার মাদকাসক্ত কর্মীকে দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। ভাবনার পরের প্রত্যাশাগুলো হলো রাজধানীসহ সারা দেশের যানজট নিরসন, প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন। তিনি চান দেশের প্রতিটি হাসপাতালকে যেন মনিটরিংয়ের আওতায় নেওয়া হয় এবং সেগুলোতে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়।