স্মরণ

কলকাতায় যখন মাটির ময়না

>আজ তারেক মাসুদের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। আরও স্মরণ করছি ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তাঁর সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া শ্রদ্ধেয় মিশুক মুনীর এবং ওয়াসিম, মুস্তাফিজ ও জামালকে। আপনারা যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন।
মাটির ময়না ছবির একটি দৃশ্য
মাটির ময়না ছবির একটি দৃশ্য

মোট ৩৫টি দেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন শেষে ভারতে মুক্তি পায় মাটির ময়না। বলা প্রয়োজন ওই মুক্তির অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। বাংলাদেশে ভারতীয় চলচ্চিত্র বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন শুরু হওয়ার আগে এখানে যেমন প্রতিবাদ হয়েছে, একই ঘটনা কলকাতায়ও হয়েছে।

ভারতে মাটির ময়নার পরিবেশনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আগ্রহী হয় কলকাতার এসআরএফটিআইয়ের (সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট) অধ্যাপক বীরেন দাশ শর্মার প্রতিষ্ঠান ‘ডিজি ম্যাজিক’। সময়টা ২০০৭ সালের জুলাই মাস। এর মাত্র কয়েক দিন আগে দীর্ঘ গবেষণা ও কাটাছেঁড়ার পর কাগজের ফুল ছবির প্রাথমিক পাণ্ডুলিপিটি প্রস্তুত হয়। জুলাইয়ের মধ্যভাগে তারেক মাসুদ, ক্যাথরিন মাসুদ এবং আমি কলকাতায় যাই। উদ্দেশ্য, কলকাতায় মাটির ময়নার মুক্তির সময় উপস্থিত থাকা এবং একই সঙ্গে কাগজের ফুল ছবির জন্য কলকাতার অংশের লোকেশন ও শিল্পী নির্বাচন করা। নন্দনে মাটির ময়না মুক্তির দিন ধার্য করা হয় ২৯ জুলাই, রোববার। ২২ জুলাই নিউমার্কেটের কাছে একটি অভিজাত হোটেলে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ, মৌসুমী ভৌমিকসহ আরও অনেকে।
হঠাৎ একদিন খবর আসে নন্দন কর্তৃপক্ষ ছবিটি প্রদর্শন নিশ্চিত করতে পারছে না। কারণ, ‘ইমপা’ (ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশি ছবি কলকাতায় বাণিজ্যিকভাবে চলতে দিলে স্থানীয় ছবি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারেক মাসুদ খানিকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। অস্বস্তিতে পড়েন বীরেন দাশ শর্মা।
এদিকে সংবাদটি জানাজানি হওয়ায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই এ নিয়ে আলোচনা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশনের প্রতিবেদক আসছেন সাক্ষাৎকার নিতে। তারেক মাসুদ তাঁর স্বভাবসুলভ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উত্তর দেন সব প্রশ্নের। সবাইকে পুরোপুরি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, এমন নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি সংস্কৃতির চাপে আছে, বাংলা সংস্কৃতির নয়। বাংলাদেশের দু-একটা ছবি এলেই পশ্চিমবঙ্গের ছবি বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতটা খারাপ অবস্থা তাদের নয়। তা ছাড়া এটা তো একতরফা হবে না, নিশ্চয়ই বিনিময় হবে। সব ধরনের ছবিও আসবে না, শুধু শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের বিনিময় হবে। এখানকার ভালো ছবিও বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন করার উদ্যোগ আপনারা নিতে পারেন। আর এটা এমন একসময়ে হতে যাচ্ছে, যখন দীর্ঘদিনের অপেক্ষা শেষে প্রায় ৪৫ বছর পর দুই বাংলার মাঝে আবার সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ চালু হচ্ছে। এরপর হয়তো পারস্পরিক অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে আসবে।’

তারেক মাসুদ (৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬–১৩ আগস্ট ২০১১)

সংবাদ সম্মেলনে মৃণাল সেন ছবিটির পক্ষে অনেক কথা বলে গেলেও কী এক অজানা কারণে পরে আর এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, এমন একটি পক্ষ কলকাতায় মাটির ময়নার মুক্তি প্রায় আনুষ্ঠানিক বাতিল ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদিকে কয়েকটি সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল সরাসরি বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারেক মাসুদ সেসব বিতর্কে উপস্থিত হন এবং তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ২৭ জুলাই রাতের একটি টেলিভিশন টক শো পুরো চিত্রটা পাল্টে দেয়। তখন তারা বাংলায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন কবির সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়)। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন তারেক মাসুদ ও ইমপার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তপন ঘোষাল। এই বিতর্কে দুজনই যার যার অবস্থান তুলে ধরেন। আলোচনায় তারেক মাসুদের চেয়ে স্মার্ট উপস্থিতি আর কারও হতে পারে, এটা ভাবা একটু কষ্টকর বৈকি। হয়েছেও তা-ই। আলোচনার ফাঁকে মুঠোফোনের খুদে বার্তার মাধ্যমে দর্শকের ভোট দেওয়ার একটি পর্ব রয়েছে। আলোচনা শেষে দর্শক জরিপে দেখা যায় প্রায় ৮০ শতাংশ দর্শক মাটির ময়না দেখার পক্ষে এবং এই ধরনের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র বিনিময়ের পক্ষে রায় দিয়েছেন। হঠাৎ পুরো অবস্থাটি মাটির ময়নার পক্ষে চলে আসে।
সরকারও ভাবতে বাধ্য হয়, যে ছবি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাণিজ্যিক প্রদর্শনের অনুমতি দিয়েছে, সে ছবি প্রদর্শন আঞ্চলিক সরকার বন্ধ করে কী করে! একই সঙ্গে দর্শক মতামতকে গুরুত্ব দিলেও এই ছবি প্রদর্শন বন্ধ করা সরকারের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। ফলে মাটির ময়না সেখানে জিতে যায়। ২০০৭ সালের ২৯ জুলাই মাটির ময়না মুক্তি পায় নন্দনে।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা
proshoon.rahmaan@gmail.com