>
৭ ডিসেম্বর ঢাকায় শুরু হয়েছে ১৫তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব। শেষ হচ্ছে আগামীকাল। এ উপলক্ষে এখন ঢাকায় মুক্ত ও সমান্তর সিনেমার অনেক পুরোধা ব্যক্তিত্বের দেখা মিলছে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল যে দুই নক্ষত্র বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের এই আয়োজনে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন, তাঁরা হলেন কুমার সাহানী ও কমল স্বরূপ। এ দুই ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব দেশ-জাতির গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছেন অনেক আগেই। হয়ে উঠেছেন বিশ্ব মুক্ত সিনেমার যুগপুরুষ।কমল শুধু একজন নির্মাতাই নন, তিনি এ যুগের সিনেমার এক শক্তিশালী ও নিজ স্বকীয়তায় ভাস্বর তাত্ত্বিকও বটে। তরুণ বয়সেই রিচার্ড অ্যাটেনবরা, মনি কৌল, কুমার সাহানীর মতো বড় নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। কারও সহকারী, তো কারও জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন, শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর ওম দরবদর, পুষ্কর পুরাণ, সমুদ্র মন্থন, রঙ্গভূমি—এসব সিনেমা এখন বিশ্ব সিনেমার পাঠ্য। ঢাকার বনানীর একটি হোটেলে নিজের সিনেমা–ভাবনা ও সিনেমা সফর নিয়ে কথা বলেছেন কমল স্বরূপ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিপ্লব কুমার রায়।
বিপ্লব কুমার রায়: এই প্রথম বাংলাদেশে এলেন?
কমল স্বরূপ: হ্যাঁ। এই প্রথম।
বিপ্লব: উৎসবে সিনেমা দেখে কেমন বোধ হলো? বাংলাদেশ ও সমকালীন বিশ্বের তরুণ নির্মাতারা কেমন সিনেমা বানাচ্ছেন?
কমল: নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা প্রযুক্তির কল্যাণে সারা বিশ্বের সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন এখন। তাঁরা খুবই দক্ষ। তাঁদের পেছনে সিনেমার একটা ইতিহাস রয়েছে। তাঁরা প্রোগ্রেসিভ চিন্তা করার সুযোগও পাচ্ছেন। হাইগ্রেড কম্পিউটার আছে। তাঁরা আমাদের থেকে ‘বেটার কম্পিউটার’।
বিপ্লব: আপনি এফটিআইআইয়ে খুব কম বয়সে গিয়েছিলেন।
কমল: ১৯ বছর বয়সে ভর্তি হই। বাইশেই আমি পাস করে বেরিয়ে গেছি।
বিপ্লব: এত কম বয়সে সিনেমার মৌলিক ভাবনায় আপনার বেড়ে ওঠা কীভাবে হলো?
কমল: আমি তো এফটিআইআইয়ে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে, হাঁপ ছেড়ে বাঁচার জন্য। একটু একলা থাকব, একলা কামরা পাব—কিছুটা এই প্রলোভনে। তখন আমার সিনেমা নিয়ে একেবারেই কোনো ভাবনা ছিল না। এমনকি ৩০ বছর পর্যন্ত আমি সিনেমা বানাব, এমন চিন্তায় তাড়িতই হইনি।
বিপ্লব: তাহলে এমন একটি অবস্থা থেকে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ওম দরবদর। যা এখন পুরো বিশ্ব সিনেমার ‘কাল্ট’ আখ্যা পেয়েছে। এক লাফে কীভাবে ওম দরবদরে পৌঁছলেন?
কমল: তরুণ বয়স থেকেই আমি প্রচুর বই পড়তাম। আমাদের বেড়ে ওঠার গ্রামে তখন তো সিনেমা দেখার ব্যবস্থা ছিল না। তাই বই-ই আমাকে প্রথম চিন্তার খোরাক জোগায়। ‘ওম দরবদর’ আসে অনেকটা হঠাৎ করে। কিন্তু তার প্রস্তুতি মনে মনে হয়তো অনেক দিন ধরেই ছিল। আমি জন্মেছি কাশ্মীরে। সেখান থেকে অল্প বয়সে পরিবারের সঙ্গে রাজস্থানে আসি। সেখানেই বেড়ে ওঠা। আবার সেখান থেকেই পরে ঠাঁইনাড়া হই। আমাকে আমার কোনো গ্রামের লোকই তেমন চেনেন না। শুধু জানেন, এ ছেলে আমাদের গ্রামেরই। এ এখন কী করে? এমন একটি ছেলের ঠাঁইনাড়া হওয়ার গল্পই ওম দরবদর।
সিনেমাটা বানানোর পেছনে আরেকটি ‘পুশ’ হিসেবে কাজ করেছে আমার পরিচিত ব্যক্তিরা। তরুণ বয়সে আমার প্রচুর স্ট্রং ভয়েস ছিল। সিনেমা, উঁচু দরের সাহিত্য, চিত্রকর্ম নিয়ে অনেকের কথাকে খারিজ করে দিতাম। তখন আমার পরিচিতরা বলল, তুমি বড্ড বেশি কথা বলো। আগে একটি সিনেমা করে দেখাও। প্রমাণ করো। সেটাই আমার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরির তাড়না জোগাল।
বিপ্লব: প্রথম সিনেমাতেই এত শক্তিশালী সাবটেক্সট আর চোখে পড়ার মতো মৌলিক নির্মাণশৈলী। এটা কোথা থেকে এল?
কমল: সিনেমাটায় এসব করব, এটা মাথায় প্রথম এল অ্যাটেনবরার গান্ধীর সেটে। আমি নিজের গল্প বলার প্রস্তুতি নিলাম। অবকাঠামোটা পেলাম আমার পড়া সাহিত্যের জগৎ থেকে।
প্রথম আলো: আপনি বলেছেন, সে সময় সাররিয়ালিজম, দাদাইজম আপনার শিল্পমননে প্রভাব ফেলেছিল।
কমল: হ্যাঁ, তবে স্পেশালি দাদাইস্ট ভাবনা। এটা আমি বেছে নিয়েছিলাম, ঠিক তা নয়। এটা আমাকে টানত। এমনকি কোনো দাদাইস্ট আর্টিস্ট নয়, দাদাইস্ট সাধারণ মানুষও আমাকে টানত। আমি ড্রিমে বিশ্বাস করতাম। আর সিরিয়াস সিনেমায় গান, কৌতুকরস থাকা যাবে না, সেটি মনে করলাম না। এই সব নিয়েই ওম দরবদর।
বিপ্লব: আর সেই সিনেমা ২৬ বছর পর ২০১৪ সালে সেন্সর থেকে ‘এ’ সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তি পেল!
কমল: ‘ওম দরবদর’ তরুণ সিনেমা-চিন্তকদের ‘পাসওয়ার্ড’ হয়ে গেল। এই গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে একটা সংঘ গড়ে উঠল, যা ও-কাল্ট নামে পরিচিতি পেল বিশ্বে। ‘ওম দরবদর’ দেখে সিনেমাটার সব ঠিক থাকলেও সেন্সর ভেবেছিল, সিনেমাটাতে গুপ্ত অর্থ লুকায়িত। এই সন্দেহ থেকেই তাঁরা সিনেমাটা মুক্তির অনুমতি দিল না। সে সময় এনএফডিসিও সাহায্য করেনি। কোনো আন্তর্জাতিক উৎসব, প্যানারমাও একে সিলেক্ট করেনি।
বিপ্লব: সেই সিনেমাই কীভাবে আজকের এই উচ্চতায় পৌঁছাল?
কমল: সেন্সরে জমা দেওয়ার জন্য আমি যে ভিএইচএস কপি করেছিলাম, সেটি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে অনেকে দেখে। সেখান থেকে কপি হতে হতে শেষে সিডি, ডিভিডি হয়ে কেউ একজন টরেন্টে দেয়। সেখান থেকে সারা ভারতে বোদ্ধা-তরুণ নির্মাতারা দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এভাবে ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’ হয়ে ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে।
বিপ্লব: আপনি কমার্শিয়াল সিনেমায় গেলেন না? এমনকি এফটিআইআইয়ের প্লেসমেন্টে শ্যাম বেনেগালের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়ে গ্রামে গিয়েছিলেন বাচ্চাদের সিনেমা নির্মাণ শেখাতে?
কমল: শ্যাম আমাকে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাজ কাপুরও করেছিলেন। আমি সেসবে না গিয়ে গ্রামে গেলাম রিচার্ড লিকক নামের এক ভদ্রলোকের সিনেমা দর্শনে প্রভাবিত হয়ে। লিকক কানাডায় তখন ‘ডাইরেক্ট সিনেমা’ নামে এক আন্দোলন শুরু করেছেন, আমি সেটা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই গ্রামে বাচ্চাদের সিনেমা নির্মাণ শেখালাম।
বিপ্লব: আপনি আকৃষ্ট হলেন ভারতীয় শাস্ত্র ও পুরাণের প্রতি।
কমল: আমি মিথের ডিকনস্ট্রাকশনে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। লেভি স্ট্রস বলে এক ভদ্রলোক ‘দ্য র অ্যান্ড দ্য কুক’–এ সেটি দেখালেন। আমি ভারতীয় মিথের ডিকনস্ট্রাক্টে আগ্রহী হলাম।
বিপ্লব: আপনার সিনেমায় মিউজিক একটা আলাদা চরিত্র হয়ে হাজির হয়?
কমল: আমি সব মিউজিকের প্রতি আকৃষ্ট নই। আমার নিজের রকমের মিউজিক। অনেকটা জ্যাজ মিউজিকের মতো। কিন্তু আমার স্বকীয়।
বিপ্লব: আপনি ন্যারেটিভ স্টোরিটেলিং-এ কখনো আকৃষ্ট হননি?
কমল: হয়েছি তো! আমি তো গল্প বলতে পারি। একসময় ভিজ্যুয়ালস আমাকে আকৃষ্ট করত। কারণ আমি ভাষায় চিন্তা প্রকাশ করতে পারি না। ভিজ্যুয়ালসে দেখাতে পারি। তবে সেটা তো ন্যারেটিভ স্টোরিই তৈরি করে। আমাকে টানল পরে সাউন্ড। আমি সিনেমার অর্থোডক্সি ভাঙতে চেয়েছি। ন্যারেটিভ সিনেমা অর্থোডক্সি পয়দা করে। আমার সিনেমায় আপনি বসবেন, উঠে যাবেন, আপনাকে বেঁধে রাখা হবে না। অন্য সিনেমা ন্যারেটিভে আপনাকে বেঁধে রাখতে চায়। আপনাকে বলে, বসে থাকো। আমি এটা বলছি, এটা দেখাচ্ছি। এটাই অর্থোডক্সি। আমি সব রকম বিশ্বাসকে ভাঙতে চেয়েছি। এমনকি আমার নিজের বিশ্বাসও।
বিপ্লব: তরুণেরা যদি কমল স্বরূপের মতো বড় মাপের নির্মাতা হতে চায়, তবে কী পরামর্শ দেবেন?
কমল: বলব, আমার মতো হয়ো না (হাসি)। তবে বলব, নিজের মতো হও। নিজের একটা স্বকীয় স্টাইল খুঁজে বের করো। আর অনেক পড়ো। আর মৌলিক নির্মাতা হতে চাইলে সবাইকে খারিজ করো। এটা শুধুই সিনেমা বানানোর সময়। নচেৎ অন্য সময় সব সিনেমাই সুন্দর।