তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা মুম্বাইতে, ২০১৬ সালে, একটা পাঁচ তারকা হোটেলের বাগানে। মুম্বাইয়ে নামার পর থেকেই নানা রকম রিহার্সাল করেছি—কী কী বিষয় নিয়ে কী কী ভাবে বলব—এসব। সাধারণত কোনো ছবির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে যখন একজন পরিচালক এবং অভিনেতা মুখোমুখি হন, তখন তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয় স্ক্রিপ্ট নিয়ে, চরিত্রের অলিগলি নিয়ে। তো আমিও সেই মতোই তৈরি হচ্ছিলাম। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে আজ ভাবি, কী আশ্চর্য, আমরা সেসবের ধারেকাছেও গেলাম না! আমরা কথা বললাম ছোটবেলা, মা, বাতাস, আর ঘুমের মধ্যে যেসব স্বপ্ন দেখি, ওসব নিয়ে। তখনই বুঝলাম, আমি কথা বলছি একজন কবির সঙ্গে, দার্শনিকের সঙ্গে!
কবি আর দার্শনিক শুনলেই একধরনের একঘেয়ে এবং নিরস ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু ইরফান খানের সঙ্গে আড্ডা আর যা–ই হোক, নিরস হতে পারে না। প্রতিটি মুহূর্তে উনি আপনার সামনে কোনো নতুন দরজা খুলবেন অথবা আপনাকে দিয়ে খোলাবেন।
তারপর ধীরে ধীরে যত মিশতে থাকলাম, একধরনের সুড়ঙ্গ তৈরি করে তার ভেতরে ঢুকতে থাকলাম, ততই আবিষ্কার করলাম এক দুরন্ত কিশোরকে। যে কিশোর কৌতূহলী, দুরন্ত আর হাসিখুশি!
শুটিংয়ের ফাঁকে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। এবং সেই খেলায় সবচেয়ে বেশি কান্ঠামি করত যে দুজন, তার একজন ইরফান ভাই আর দ্বিতীয়জন অবশ্যই আমি। আউট হলেই আমরা নানা অজুহাত বের করতাম—নো বল ছিল, রেডি ছিলাম না, বাতাসের কারণে চোখে কী যেন গেছে, সুতরাং আবার বল করতে হবে! ওই সব দুরন্তপনার সময় বুঝতেই পারবেন না, আপনি পৃথিবীর সেরা অভিনয়শিল্পীদের একজনের সঙ্গে পাড়ার ক্রিকেট খেলছেন! এই যে নিজের অবস্থানকে নিজেই ভুলে যেতে পারা—এটা যেকোনো বড় মানুষের বড় গুণ।
এই গুণই তাঁকে মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে মহৎ করেছে। আমাকে আমার বিভিন্ন দেশের বন্ধুরা যখন জিজ্ঞেস করত, তাঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন, সেটে কেমন ছিলেন তিনি; আমি বলতাম, সেটের মধ্যে ঘাসফুল হয়ে ফুটে থাকতেন ইরফান খান! ঘাসফুল যেমন অলক্ষ্যে ফুটে থাকে কোনো আওয়াজ না দিয়ে, তার উপস্থিতি জাহির না করে, ইরফান খানও একই রকমভাবে ফুটে রইতেন!
কারণ, উনি তো কবি। উনি তো জানেন, এই সকালের কী মানে, মধ্যাহ্নেরই কী মানে, কিংবা সাঁঝের।
তাঁর ভেতরের যে কবিসত্তা, দার্শনিক সত্তা, এটা তাঁর অভিনয়টাকেও সহজ করে দিয়েছিল। অভিনয়টা কী আসলে? আরেকটা মানুষের মানসিক অবস্থাটা ফুটিয়ে তোলা—এই তো? এই কাজটা করতে হলে তো সবার আগে যে গুণটা থাকতে হবে, সেটা হলো জীবনের বিচিত্র অনুভূতিগুলো চিনতে পারা, একটার সঙ্গে আরেকটার মিল কী বা অমিল কী, সেটা বুঝতে পারা। এটা কবির চেয়ে বেশি কে আর বুঝতে পারে? অথবা ঘুরিয়ে বলা যায়, এটা যে বুঝতে পারে, সে-ই তো কবি।
ইরফান খান অসুস্থ ছিলেন, আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হতো, উনি অসুখটাকে হারাবেনই। এই বিশ্বাস আরও পোক্ত হয়েছিল লন্ডনে আমার এবং তিশার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর।
কিন্তু আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠে যা শুনলাম, সেটা বিশ্বাস করতে আরও কিছু সময় লাগবে আমার! সবাই তাঁকে বলে ভারতীয় সিনেমার 'গ্লোবাল ফেস'। আমি বলি, বিশ্ব চলচ্চিত্রের সম্পদ একজন ইরফান খান। দুঃখ হলো, এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।