একজন শুদ্ধতম মানুষের প্রস্থান

আবুল হাসনাত।
ছবি:বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে।

মাঝেমধ্যে চারদিকের পরিস্থিতি দেখে যখন হতাশ হয়ে পড়তাম, তখন বন্ধুবর মফিদুলকে বলতাম, ইচ্ছা করে হাসনাত হয়ে যাই। আবুল হাসনাত। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পাদক এবং আমার দেখা একজন শুদ্ধতম মানুষ। আজ সকালে যখন আমার মেয়ে হাসনাতের চলে যাওয়ার সংবাদটা দিল, তখন আমার কাছে এ নিষ্ঠুর সংবাদ অসহ্য মনে হলো। এই সেদিনও লুভা নাহিদ চৌধুরী আশ্বস্ত করেছিলেন যে সংকট কেটে গেছে। হাসনাত একটু উঠে বসতে পেরেছেন।

হাসনাত স্বভাবে ছিলেন নম্র, বিনয়ী ও লাজুক।

জীবনে আমি দেশে-বিদেশে অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। কিন্তু হাসনাতের মতো একজন খাঁটি মানুষ আর দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। ‘নিভৃতচারী’ ও ‘নিরহংকারী’ শব্দ দুটো তাঁর চেয়ে আর কারও বেলায় বোধ হয় বেশি প্রযোজ্য হতে পারে না।

হাসনাত স্বভাবে ছিলেন নম্র, বিনয়ী ও লাজুক। নেপথ্যে থেকে সব কাজ করতেন কিন্তু সামনে আসতে চাইতেন না। কালি ও কলমের নানা অনুষ্ঠানে তাঁকে মঞ্চে বসতে হতো। কিন্তু চোখে–মুখে ফুটে উঠত কুণ্ঠা। মঞ্চ থেকে নামতে পারলেই যেন বাঁচেন। যা বলবেন, সব সময় লিখে নিয়ে আসতেন। আমাদের বলতেন, ‘মাইকের সামনে কথা বলতে গেলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই। ’

রামেন্দু মজুমদার
জীবনে আমি দেশে-বিদেশে অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। কিন্তু হাসনাতের মতো একজন খাঁটি মানুষ আর দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। ‘নিভৃতচারী’ ও ‘নিরহংকারী’ শব্দ দুটো তাঁর চেয়ে আর কারও বেলায় বোধ হয় বেশি প্রযোজ্য হতে পারে না।
রামেন্দু মজুমদার

সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তাঁর যে দক্ষতা, মেধা ও কৃতিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন, তা তাঁর অনুসারীদের আদর্শ হয়ে থাকবে। সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী বিষয়বৈচিত্র্যে, গুণগত মানে ও অলংকরণে আর দশটা পত্রিকা থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যেত। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল সাময়িকীর দায়িত্বে থাকা আবুল হাসনাতের জন্যই। সংবাদে তখন লেখার জন্য সাহিত্যানুরাগীরাও উৎসাহী হতেন। বিষয় বিবেচনা করে গুণী লেখকদের অনুরোধ করে লেখা আদায় করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর মতো শিল্পীর কাছ থেকে কী কৌশলে দ্রুত কাজ করিয়ে নিতেন, তার রহস্য আমাদের অজানা।

‘কালি ও কলম’–এর দায়িত্ব নিয়ে হাসনাত খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। সংবাদের আর্থিক অনিশ্চয়তার পর এখানে সে নিশ্চিন্ত মনে কাজ শুরু করেছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্নেহচ্ছায়ায় থেকে মনের মতো করে পত্রিকাটি সাজিয়েছিলেন। যার ফলে দ্রুতই ‘কালি ও কলম’ বাংলা ভাষার একটা অগ্রগণ্য মাসিক সাহিত্য পত্রিকা হয়ে ওঠে। প্রত্যেক সংখ্যাই আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। চিত্রশিল্পের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগের ফলে প্রতি সংখ্যার প্রচ্ছদেই একজন বিশিষ্ট চিত্রকরের কাজ আমরা দেখতে পেতাম। ভেতরের লে-আউটে তার যত্নের ছাপ সহজেই বোঝা যেত।
সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল চিত্রশিল্পের প্রতি। সমকালীন চিত্রকরদের কাজ নিয়ে অনেক লেখা রয়েছে তাঁর। ‘জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য’ চিত্রশিল্পের ওপর তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।

হাসনাত কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্মনামে। এর কার্যকারণ কোনো দিন জানতে পারিনি। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক’, ‘কোনো একদিন ভুবনডাঙায়’, ‘ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল’ ও ‘নির্বাচিত কবিতা’। তাঁর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ও গল্প সংকলন দুটি ঐতিহাসিক দলিল।

আবুল হাসনাত

আবুল হাসনাতের আত্মস্মৃতি ‘হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে’ এবারের একুশে গ্রন্থমেলার শেষ দিন প্রকাশিত হয়েছে। তারিক সুজাতের বারবার তাগাদার ফলে দ্রুতই ‘জার্নিম্যান বুকস্’ থেকে বইটি বেরোতে পারল। নইলে নিজের জীবনের কথা লিখতে তাঁর খুবই কুণ্ঠা ছিল। বলতেন, ‘আমার আবার এমন কী জীবন যার কথা লেখা যায়।’ কিন্তু তাঁর এই বইয়ে ষাটের দশকের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার দিনগুলোর একটা অনুপুঙ্খ ছবি আঁকা হয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধদিনের অনেক অজানা ঘটনা তাঁর কলমে ফুটে উঠেছে। মেলার শেষ দিন বইটি প্রকাশিত হয়েছিল বলে আমি তা সংগ্রহ করতে পারিনি। পরে বইটির কথা শুনে যখন তাঁকে ফোনে আমার আগ্রহের কথা জানালাম, লকডাউনের মধ্যে হাসনাত আমাকে বইটি পাঠিয়ে দিলেন। আমি পাতা ওলটাতে গিয়ে দেখলাম, এক জায়গায় তাঁর একটি স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত ঘটনার উল্লেখ আছে। আমি তাঁকে ফোন করে তা বলতেই তাঁর জবাব, কী কাণ্ড! এত বড় বইয়ের মধ্যে আপনার চোখ ওই জায়গাতেই পড়ল?

হাসনাত ছিলেন মৃদুভাষী ও নি¤কণ্ঠ, কিন্তু উচ্চারিত শব্দের ওজন ছিল অনেক। গত মার্চ থেকে আমরা যখন অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছি, তখন দু–এক দিন পরপরই হাসনাতের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। ওঁর সঙ্গে কথা বলে একদিকে যেমন আনন্দ পেতাম, অন্যদিকে জানতে পারতাম অনেক কিছু। ওঁর লেখাপড়ার বিস্তৃতি ছিল অনেক।

আবুল হাসনাত

ফোন করে প্রথমেই জানতে চাইতেন আমার কথা বলার সময় হবে কি না। আমি যখন বলতাম, এত বিনয়ের কী প্রয়োজন? তখন তাঁর জবাব ছিল, না আপনারা সর্বক্ষণ নানা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে ব্যস্ত থাকেন, তাই জেনে নিলাম। আমরা পারস্পরিক ঠাট্টা–মশকরা খুবই উপভোগ করতাম। আমি, মফিদুল আর হাসনাত একসঙ্গে যখন আড্ডা দিতাম, তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। ওঁর সংগ্রহে প্রচুর চিত্রকর্ম ছিল। ঘরের দেয়ালে সব জায়গা হতো না। মফিদুল বলতেন, এগুলো এখন দেখছেন হাসনাত ভাইয়ের সামার কালেকশন, কিছুদিন পর সব বদলে দেয়ালে ঝুলবে উইন্টার কালেকশন। হাসনাত মিটিমিটি হেসে এসব ঠাট্টা উপভোগ করতেন।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ছিলেন হাসনাতের আবাল্য বন্ধু। কিছুদিন আগে মতি বলছিলেন যে, ‘আমার একটা পরিকল্পনা আছে। হাসনাতের এই আত্মস্মৃতিমূলক বইটাকে উপলক্ষ করে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করব, যেখানে আমি হবো একক বক্তা। হাসনাতকে সাক্ষী রেখে ওর জীবনের কথা বলবো।’ কিন্তু সে অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম।
হাসনাতের খুব প্রিয় জায়গা ছিল কলকাতা আর শান্তিনিকেতন। যখনই সুযোগ পেতেন, আমাদের কাউকে জানান না দিয়ে চলে যেতেন কলকাতায় বা ভুবনডাঙায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকরদের সঙ্গে তাঁর ঈর্ষণীয় সখ্য গড়ে উঠেছিল। শম্ভু মিত্রকে নিয়ে অনেক লেখাপড়া করেছেন। উৎপল দত্ত ও বাদল সরকারের কাজ নিয়েও ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ।
আজ (রোববার) দুপুরে যখন তাঁর কর্মস্থল বেঙ্গল শিল্পালয়ে আমরা তাঁর গুণগ্রাহীরা সমবেত হয়েছি তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, দেখলাম তাঁর প্রশান্ত মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই। অসুস্থতার একটু উপশমের মুখে মৃত্যু এসে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল অকালে। প্রথাগত শোকবার্তা নয়, সত্যি সত্যি তাঁর শূন্যস্থানটি পূরণ হবার নয়।
হাসনাত বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজে, আমাদের স্মৃতিতে। হাসনাত, আপনি যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন। ‘সমুখে শান্তি পারাবার’।

আবুল হাসনাতের শেষ বিদায়।