একজন নোবেলম্যান

কথা শেখার সময়টাতে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন নোবেল। তারপর পরিবার, এমনকি বাড়িওয়ালারও বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি। সেই নোবেল এখন জি বাংলার ‘সারেগামাপা’ মাতিয়ে রেখেছেন। দুই বাংলার কোটি কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করেছেন বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের এই তরুণ। কী আছে তাঁর কণ্ঠে? কী করে এলেন এই গানের মতো মহাসমুদ্রে। এবারের প্রচ্ছদে জেনে নিন নোবেলের গল্প।


প্রশ্ন করলাম, আপনার প্রথম শেখা গান কোনটা? নোবেল চোখটা মিটি মিটি করলেন বার কয়েক। অনেকক্ষণ আলাপের পর বোঝা গেল এটা তাঁর অভ্যাস। বললেন, খুব ছোটবেলায় বাবা বাড়িতে গানের ক্যাসেট আনতেন। সেগুলো সবাই মিলে শুনতাম। শুনে শুনে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসানের গান তুলতাম। ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘চারদিকে উৎসব’ গানগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

নোবেল। ছবি: কবির হোসেন
নোবেল। ছবি: কবির হোসেন

প্রসঙ্গ ধরেই নোবেলের ছোটবেলায় প্রবেশ করা। ভারতীয় চ্যানেল জি বাংলার গানবিষয়ক রিয়্যালিটি শো সারেগামাপা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাঈনুল আহসান নোবেল এখন জনপ্রিয় মুখ। এই তরুণের গান শুনে মুগ্ধ এখন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শ্রোতারা। তাঁর গান শুনে অনেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন আইয়ুব বাচ্চুকে, কখনো মনে হয়েছে জেমস গাইছেন। আবার লোকগানও মানিয়ে গেছে নোবেলের পানির মতো সহজ কণ্ঠে।

জি বাংলা সূত্রে এত দিনে সবাই জেনে গেছেন নোবেলের বাড়ি গোপালগঞ্জে। বাবা ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মা গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে নোবেল সবার বড়। বড় ছেলে হিসেবে বাবা–মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে পড়াশোনা শেষ করে ‘বড়’ কিছুই হবেন। কিন্তু গান যখন গলার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে ফেলল, তখন নোবেল বুঝে গিয়েছিলেন তাঁকে আসলে গানেই থাকতে হবে। গান গেয়েই পূরণ করতে হবে মা–বাবার সেই ‘বড়’ হওয়ার স্বপ্ন।

গোপালগঞ্জ–খুলনা–ঢাকা–কলকাতা

নোবেল জন্মেছেন গোপালগঞ্জে। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন বিভিন্ন জায়গায়। বাবার ছিল পরিবহনের ব্যবসা। সেই সূত্রে কখনো খুলনা, কখনো ঢাকায় কেটেছে ছোটবেলা। আঙুলের কর গুনে নোবেল বললেন, আমি থ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স পর্যন্ত গোপালগঞ্জের এস এম মডেল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়েছি। ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই ঢাকার একটি স্কুলে। কিন্তু সেখানে ভালো লাগে না। যাই খুলনায়। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি ওখানে। একের পর এক স্কুল বদলাতে বদলাতে আমি কাহিল হয়ে যাই। একেকবার একেক পরিবেশ, একেক নিয়মকানুন, নতুন নতুন বন্ধু। এরপর নাইনে এসে আবার ভর্তি হই গোপালগঞ্জের একটি স্কুলে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকতে পারি না। একটা মারামারির ঘটনায় আমাকে টিসি দিয়ে বের করে দেয়। তখন বাবা দেশেই রাখতে চান না। পাঠিয়ে দেন দার্জিলিং। পাশের শহর কাশিয়াংয়ে হিমালি বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষার্থী হয়ে যাই সে বছর। ভর্তি হই নাইনে। একটানা বলে থামেন নোবেল। এই ফাঁকে নোবেল সম্পর্কে একটা বাড়তি তথ্য দেওয়া যেতে পারে। গুছিয়ে কথা বলা মানুষ নোবেল। একটানা কথা বললে থামানো কঠিন হয়ে যায়।

চ্যানেল জি বাংলার গানবিষয়ক রিয়্যালিটি শো সারেগামাপা অনুষ্ঠানের মঞ্চে গাইছেন নোবেল

নাইনে তিনবার, বাসাবদল চারবার

হাসতে হাসতে নোবেল বলেন, জানেন, আমি ক্লাস নাইনেই তিনবার পড়েছি। দুইবারের হিসাব মিলল। আরেকবার? প্রশ্ন টেবিলে তোলার আগেই উত্তর প্রস্তুত করেছেন নোবেল। হিমালি বোর্ডিং স্কুলের নাইন শেষ করেছি। কিন্তু আর ওখানে পড়তে ইচ্ছা করেনি। এসে ভর্তি হই কলকাতার হাজরার একটি স্কুলে। আবার নাইনে! এবার হিসাব মেলে। দ্য কেমব্রিজ স্কুলের শিক্ষার্থী হয়ে পাস করেন এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের ও লেভেল এবং এ লেভেল। এর মধ্যে আর গানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি? রে রে করে ওঠেন নোবেল। কী বলেন, এর মধ্যে গানের জন্যই আমাকে বাসা বদলাতে হয়েছে চারবার!

উৎসুক হয়ে উঠি। নোবেল উৎসাহ মেটান। এর মধ্যে আমার সঙ্গী হয়েছিল ৬০০ টাকা দিয়ে কেনা একটা পুরোনো সিগনেচার ব্যান্ডের গিটার। যেটা এখনো আছে। সেই গিটার নিয়ে সব জায়গায় হেড়ে গলায় গান গাইতেন। গান গাইবেন বলে কলকাতায় বাসা নিয়েছিলেন গলির শেষ মাথায়। নীরব, সুনসান এলাকায় রাত তিনটায় চিৎকার করে উঠত নোবেলের গলা। ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়। ছাড়তে হয় সেই বাসা। একবার দুবার নয়, চারবার। পরে কলকাতার এক বন্ধু নিজেদের বাগানবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন নোবেলকে। সেখানেই নিয়মিত গানের চর্চাটা চালাতে থাকেন নোবেল।

 যে কারণে বাবার সঙ্গে অভিমান

এইচএসসি পাস করে সোজা ঢাকায়। সময়টা ২০১৪। তত দিনে পুরোদস্তুর গানের সঙ্গে প্রেম হয়ে গেছে নোবেলের। বাবা–মাকে সোজা জানিয়ে দেন, বই–খাতা কিংবা বড় চাকরি নয়, আমার প্রেম আসলে গানের সঙ্গে। এই প্রেম ভাঙা যাবে না।

এমন বার্তা পেয়ে কোনো মা–বাবাই চিন্তামুক্ত হতে পারবেন না। নোবেলের বাবাও পারেননি। ছেলেকে নিয়মিত পড়াশোনার জন্য বারবার বলতে থাকেন। মায়ের চাপ ছিল। কিন্তু অনড় নোবেল। উদাহরণ দিতেন, ‘জিম মরিসন মাত্র সেভেন পাস, আমাদের গুরু জেমস পড়াশোনা না করে বাসা ছেড়েছিলেন। আমিও তাঁদের মতো হব।’

বাবা উত্তর দিতেন, ‘তুমি তাঁদের মতো কখনোই হতে পারবা না। পারলে হয়ে দেখাও? জেমস একজনই!’

নোবেল উত্তর দিতেন, ‘আমিও একজনই। আমি তাঁদের মতোই হব। আমি জেমস না হতে পারি, নোবেল হব।’

নোবেল জানান, সারেগামাপার সফলতা আসার আগেই বাবার সঙ্গে নিয়মিত কথা–কাটাকাটি হতো। পরিবার থেকে বলত, পড়াশোনা প্রথমে, দ্বিতীয় হোক গান। কিন্তু নোবেল গানকেই প্রথম অবস্থানে জায়গা দেন। কারণটা পরিষ্কার। নোবেল বলেন, আমার একটা বিশ্বাস ছিল, মিউজিক আমাকে বদলে দেবে। মিউজিক আমাকে আপন করে নেবে। যেটা চাকরি–বাকরি থেকে সম্ভব না।

প্রশ্ন করি, বাড়ি থেকে বড় কোনো চাপ আসেনি?

এবার নোবেল খানিকটা আড়মোড়া ভাঙেন বোধ হয়। আমি আসলে কোনো কিছুই গায়ে মাখাই না। আমি আমার গতিতে আগাই। বাবা হয়তো বলতেন, পড়াশোনা না করলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। আমি বলতাম, ছেলে হিসেবে তো বাড়িতে আমারও অধিকার আছে। নোবেলের ভাষায়, আমাদের (বাবা–ছেলের) অনেকটা টম অ্যান্ড জেরির সম্পর্ক ছিল। আমি জানতাম বাবা তাঁর জায়গায় একদম ঠিক। কিন্তু আমিও যে ঠিক, এটা প্রমাণ করার জন্য তো সময় লাগবে। এই কারণে ধৈর্য ধরে থাকতাম। যা বলছে বলুক, আমি আমার মতো করে এগিয়ে যাই।

গত সোমবার প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সেলফি শিকারি ভক্তদের হাতে পড়েন নোবেল

গানে নোবেলের অনুপ্রেরণা

এই সময়ে নোবেলের গানের শ্রোতা কোটি কোটি। কিন্তু জানেন কি, কোন শ্রোতাদের অনুপ্রেরণায় আজকের নোবেলের জন্ম? প্রশ্ন করতে হয় না। নোবেল আগ্রহী হয়েই বলা শুরু করেন। আমি যখন কলকাতায় ছিলাম, তখন বন্ধুদের কাছ থেকে গিটারের কর্ড শিখি। গান গাওয়া শিখি। ওই সময় আমার বাসার সামনে কয়েকজন শ্রোতা নিয়মিত আসত। ওরা আশপাশের বাড়ির। সিনিয়র বন্ধু সব। এখনো আমার নাম মনে আছে, হেমন্ত, হ্যাপি, আদিবসহ কয়েকজন। ওরা ছিল আমার নিয়মিত শ্রোতা। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দিনের শেষে আমার একটা গান শুনে যেত। ওরা আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। উৎসাহদাতা। ওরা না থাকলে হয়তো এত দ্রুত গানে আসা কঠিন হয়ে যেত।

২০১৬ সালে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন গানটাই করবেন নোবেল। গড়ে তোলেন একটা ব্যান্ডও। সেখানে নিয়মিত প্র্যাকটিস করতেন। সেটা এই সময়ে এসে খুব কাজে লেগেছে বলে জানান নোবেল। নোবেলের সে রকম কোনো ওস্তাদ নেই। নেননি কোথাও প্রশিক্ষণও।

 একজন নোবেলম্যান

তারপরের গল্প সবারই জানা। নোবেল অংশ নেন জি বাংলার অডিশনে। বিচারকদের শোনান জেমসের ‘বাবা’ গানটি। ভিডিও কলের মাধ্যমে আরও কয়েকবার অডিশন দেন। তারপর পান কলকাতার টিকিট। বাকিটা তো ইতিহাস। যে ইতিহাসের সাক্ষী দুই বাংলার ‘সারেগামাপা’র শ্রোতারা।

এখন নোবেল স্বপ্ন দেখছেন একটা ব্যান্ড করার। দলের নাম দিয়েছেন নোবেলম্যান। এই নামে একটা ইউটিউব চ্যানেলও আছে তাঁর। ইচ্ছা আছে নোবেলম্যান ছড়িয়ে যাবে দেশ–বিদেশে। তাঁর গলায় ভর করে ছড়িয়ে যাবে বাংলা গানও।

এক নজরে নোবেল
পুরো নাম: মাঈনুল আহসান।
ডাকনাম: নোবেল
বাবা: মোজাফফর এইচ নান্নু
মা: নাজমা বেগম
গ্রাম: লতিফপুর, গোপালগঞ্জ
ভাইবোন: দুই ভাই, এক বোন।
প্রথম স্কুল: ঢাকার গুলশানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। শেষ কলেজ: দ্য ক্যামব্রিজ স্কুল, কলকাতা।
প্রথম গিটার: সিগনেচার ব্রান্ডের একটি গিটার।
সারেগামাপায় গাওয়া প্রথম গান: জেমসের ‘বাবা’।