পাঁচ বছর বয়সী চার্লি চ্যাপলিনকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যায় স্টেজ পারফর্ম করতে গেলেন তাঁর মা হান্নাহ চ্যাপলিন। হান্নাহ জনপ্রিয় মঞ্চ অভিনেত্রী। গ্রিন রুমে তাঁর মেকআপ নিতে একটু দেরি হচ্ছে। দর্শকেরা হই হল্লা শুরু করেছে। দর্শক ঠান্ডা করার জন্য পিচ্চি চ্যাপলিনকে গ্রিনরুম থেকে ঠেলে স্টেজে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। স্টেজে উঠেই এত মানুষ দেখে থতমত খেলো ছোট্ট চার্লি চ্যাপলিন। এদিকে উদ্ভট ড্রেস পরা এক বাচ্চা দেখে মজা পেয়ে সবাই হই হই করে উঠল। ভয় পেয়ে ডানে দৌড় দিল চ্যাপলিন। এ দিকটা বন্ধ। হো হো করে হেসে উঠল দর্শক! দিল এবার উল্টো দিকে দৌড়। দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট। আবারও সবার হো হো হাসি। গ্রিনরুমে উধাও চার্লি চ্যাপলিন। হাসি আর তালিতে ফেটে পড়ল দর্শক!
ছোট্ট চার্লি চ্যাপলিন ভাবল, মানুষ হাসান এত মজার? সেই শুরু।
কিন্তু মজার ছিল না চার্লি চ্যাপলিনের ছোটকালের জীবন। মা-বাবার মঞ্চ অভিনয়ই সংসারের আয়ের উৎস। বাবা ছিলেন মদ্যপ। মা হয়ে পড়েন অসুস্থ। মাত্র ৮ বছর বয়সে নিজের উপার্জন নিজেকে করতে হয় ব্রিটিশ কিংবদন্তি চার্লি চ্যাপলিনকে। নামী এক থিয়েটার গ্রুপে কাজ করে শিশু চার্লি চ্যাপলিন। শিশু চার্লির সেন্স অব হিউমার আর অভিনয় আস্তে আস্তে তাঁকে থিয়েটারে জনপ্রিয় করে তোলে। ১১-১২ বছর বয়সেই তাঁর নির্বাক কমেডি নাড়া দেয় পুরো ইংল্যান্ডকে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে এক মুভি কোম্পানির সঙ্গে সাইন করে জনপ্রিয় চার্লি চ্যাপলিন রওনা দেন যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে তিনি তাঁর মা-বাবাকে হারিয়েছেন।
আমরা তখন স্কুলে পড়ি। বন্ধুরা ভিডিও ক্লাব থেকে চার্লি চ্যাপলিনের ক্যাসেট এনে দেখি, পরে তা নিয়ে বিশ্লেষণ করে হো হো করে হাসি। ‘দ্য গোল্ড রাশ’, ‘মডার্ন টাইমস’, ‘সিটি লাইটস’সহ আরও কত কী! ‘দ্য গোল্ড রাশ’ মুভিতে চুলোর হাঁড়িতে জুতা সেদ্ধ করে, প্লেটে বেড়ে, কাঁটা চামচ দিয়ে চার্লি চ্যাপলিনের সেই জুতো খাওয়ার দৃশ্য যে দেখেনি, সে পৃথিবীর অর্ধেক হাসির দৃশ্য দেখেনি। জুতার ফিতাকে নুডলসের মতো পেঁচিয়ে, বড় পেরেকগুলোকে চিকেনের হাড্ডির মতো মজা করে চুষে খাওয়া যে কী আর্ট হতে পারে, তা না দেখলে বোঝানো যাবে না। ‘সিটি লাইট’স মুভিতে শহরের নতুন উন্মোচিত স্থাপত্য মূর্তির কোলে পথের মানুষের দারিদ্র্যকে কমেডি দিয়ে যেভাবে হাইলাইট করেছেন, তা এক মহাকাব্য!
একের পর এক হিট হতে থাকে চার্লি চ্যাপলিনের মুভিগুলো। ভয়াবহ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চার্লি চ্যাপলিন। এতটাই জনপ্রিয় যে একবার যুক্তরাষ্ট্রের এক উঁচু মানের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় প্রথম ১০ জনের ৯ জনই চার্লি চ্যাপলিন সেজে এসেছিল!
চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে হিটলারের মিল আছে। চমকে গেলেন? বলছি। একই বছর একই মাসে জন্মেছিলেন তাঁরা। দুজনের একই রকম গোঁফ ছিল। একজন ভয়াবহভাবে পরিচিত হয়েছিলেন মানুষকে হাসিয়ে আর আরেকজন ভয়াবহভাবে পরিচিত হয়েছিলেন মানুষকে কাঁদিয়ে! পরবর্তী সময় তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ মুভিতে হাস্যকর হিটলারের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করেন এই কমেডি লিজেন্ড।
হাসিয়ে শুধু জনপ্রিয়তাই পাননি চার্লি চ্যাপলিন, দুহাতে কামিয়েছেন অকল্পনীয় অর্থ। আজ থেকে ১০০ বছর আগে তরুণ চার্লি চ্যাপলিনের সপ্তাহে আয় ছিল ৮ লাখ টাকার ওপর। হ্যাঁ, সপ্তাহে ৮ লাখ। আজ থেকে ১০০ বছর আগে!
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ছিলেন চার্লি চ্যাপলিনের ভক্ত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
রাশিয়ার এক ভক্ত নভোবিজ্ঞানী তাঁর আবিষ্কৃত উপগ্রহের নাম রাখেন ৩৬২৩ চ্যাপলিন!
বিজ্ঞানীর রাজা আলবার্ট আইনস্টাইন একবার চার্লি চ্যাপলিনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কমেডিয়ান, আমি পদার্থবিদ। তোমাকে আর আমাকে দেখে লোকজন একই ভাবে তালি দেয় কেন?’ চার্লি চ্যাপলিন গম্ভীরভাবে বলেন, ‘আমাকে মানুষ বুঝে তালি দেয়, আর তোমাকে মানুষ তালি দেয় কিছু না বুঝে!’
বিশাল আকৃতির জুতা, ঢোলাঢালা ট্রাউজার্সের দেখতে হাস্যকর চার্লি চ্যাপলিন শুধু রোমান্টিকই ছিলেন না, ছুঁড়ি থেকে বুড়ি সব মেয়ে তাঁর জন্য পাগল ছিল। একবার তার টিন এজার গার্লফ্রেন্ড আবেগে চুমু দিয়ে বলল, ‘তুমি ১০০ জন পুরুষের চেয়েও উষ্ণ!’ শুনে চার্লি চ্যাপলিন চুপ। ঘাবড়ে গেল মেয়ে। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তুমি কি মাইন্ড করেছো?’ বাচ্চা ছেলের মতো চার্লি চ্যাপলিন বললেন, ‘হ্যাঁ মাইন্ড করেছি। ১০০ জন না, ১০০০ জন পুরুষ হবে।’
নিজেই লিখতেন, নির্দেশনা দিতেন, অভিনয় করতেন আর এমনকি মিউজিক কম্পোজটাও নিজে করতেন। আপনি ভুল পড়েননি। নিজে মিউজিক কম্পোজ করতেন চার্লি চ্যাপলিন। আরও চমকানো কথাটা হচ্ছে, চার্লি চ্যাপলিন একবার অনারারি অস্কার পেয়েছিলেন; অভিনয়ে না, মিউজিক ক্যাটাগরিতে! জাত ট্যালেন্ট কাকে বলে? কত প্রকার? কী কী? বিশ্বের এই ‘এক পিস’ ট্যালেন্ট অজ্ঞাত কারণে কখনো অভিনয়ে অস্কার পাননি।
বলিউডের আমির খানকে বলা হয় ‘মি. পারফেকশনিস্ট’। অবশ্যই আমির খান ‘মি. পারফেকশনিস্ট’। কিন্তু তার চেয়েও বড় ‘পারফেকশনিস্ট’ ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। একটা ঘটনাই প্রমাণ। ‘সিটি লাইটস’ ছবিতে এক অভিনেত্রীর ছোট্ট একটি সংলাপ, ‘স্যার, এই যে ফুল।’ শটটি চার্লি চ্যাপলিন ৩৪২ বার টেক করেছিলেন পারফেক্টটি নেওয়ার জন্য। শত বছরের কিংবদন্তি কি এমনিতেই হওয়া যায়?
পৃথিবীর ইতিহাসে চার্লি চ্যাপলিনের মতো এত বড় মাপের ক্ল্যাসিক কমেডিয়ান আর আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিল। নেননি। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাঁর খুব ক্ষোভ ছিল।
বড় মানুষের কাজ-কারবার বড়। তাই বড় মাপের চার্লি চ্যাপলিনও পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান বড়দিনেই। ক্রিসমাস ডেতে। ১৯৭৭ সালে। সুইজারল্যান্ডে।
জন্মে ছোটকালে যেমন শান্তি পাননি, মরেও শান্তি পাননি। মৃত্যুর তিন মাস পর কবর থেকে তাঁর দেহ চুরি করে নিয়ে যায় এক হাইজ্যাকার। বিশাল বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে সে। পুলিশ ঝটিকা অপারেশনে নির্বাক চার্লি চ্যাপলিনকে আবার উদ্ধার করে। এবার কবর আগের চেয়ে ৬ ফুট বেশি গভীর করে খোঁড়া হয়। আর ওপরে দেওয়া হয় শক্ত কংক্রিটের ঢালাই! নে, এবার চুরি কর!
তাহলে কি বেশি বড় কাজ করলে মরেও শান্তি পাওয়া যায় না?
লেখক: নাট্যকার, নির্মাতা