>৪৪তম টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (টিআইএফএফ) শুরু হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে। চলবে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। উত্তর আমেরিকার অন্যতম বড় এই চলচ্চিত্র উৎসবে এবারও হাজির থাকবেন হলিউডের সামনের সারির বহু তারকা। উৎসবের ‘কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ বিভাগে থাকছে বাংলাদেশের একটি ছবি। টরন্টো থেকে লিখেছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
পরনে ঝলমলে গাউন। চোখে অশ্রু। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন লেডি গাগা। খুশি আর আবেগের কান্না। ওপাশে উল্লাসে ফেটে পড়েছে সমবেত জনতা। আবেগে ভারাক্রান্ত লেডি গাগাকে সামলাতে এগিয়ে এলেন নির্মাতা ব্র্যাডলি কুপার। আপ্লুত গাগা শেষতক মুখ গুঁজলেন কুপারের কাঁধে। দর্শকের হর্ষধ্বনি এবার যেন পৌঁছে গেল টরন্টো সিএন টাওয়ারের চূড়া অবধি। গেল অস্কার আসরে লেডি গাগা-ব্র্যাডলি কুপারের সেই অবিস্মরণীয় যুগল পরিবেশনার কথা কি মনে পড়ে গেল আপনার? মনে পড়ারই কথা। ঘটনা আদতেই খুব কাছাকাছি। শুধু জায়গা আর সময়ের ফারাক। অসম্ভব আবেগময় এক পরিবেশনা দিয়ে অস্কার মঞ্চে (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন লেডি গাগা-ব্র্যাডলি কুপার। আর আ স্টার ইজ বর্ন প্রদর্শনীর দিনে টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবের দর্শকেরা সেই ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন অস্কার মৌসুমের মাস পাঁচেক আগেই। বছর ঘুরে আবার টরন্টোতে এসেছে উৎসবের মৌসুম। এবারও আরেকটা তুমুল সিনেমা উৎসবের অপেক্ষায় কানাডার ব্যস্ততম শহর।
অস্কারের পূর্বাভাস
হাতের কাছেই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। সানড্যান্স এবং টেলুরাইডের মতো সম্মানজনক উৎসবও টরন্টো থেকে খুব দূরে নয়। তবু টিফের উত্তর আমেরিকার প্রধানতম চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে ওঠার বড় কারণ সম্ভবত এই অস্কার পূর্বাভাস। হলিউডে পুরস্কার মৌসুম শুরুর ঢের আগেই বছরের সেরা ছবিগুলোর ব্যাপারে আগাম সংকেত দেয় কানাডার এই চলচ্চিত্র উৎসব। শেপ অব ওয়াটার, গ্রিন বুক, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার–এর মতো অস্কারে সাড়া জাগানো বহু ছবি উত্তর আমেরিকায় তাদের জয়যাত্রা শুরু করেছিল এই টরন্টো উৎসব থেকেই। সংখ্যার হিসাব–নিকাশ আরও চমকে ওঠার মতো। শুধু ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টরন্টো উৎসবে পুরস্কার বিজয়ী ১০টি ছবি পরবর্তী সময়ে পেয়েছে সেরা ছবির অস্কার মনোনয়ন! একই সময়ে অস্কারের সব বিভাগের মনোনয়ন হিসাব করলে এই সংখ্যা ৯২!
এই উৎসবে আসতে তাই তামাম হলিউড তারকারা হামলে পড়বেন, এটাই তো স্বাভাবিক!
জনগণের উৎসব
কান-ভেনিস-বার্লিন। বিশ্ব সিনেমায় বড় উৎসব বলতে আছে ইউরোপের এই তিন প্রভাবশালী জমিদার। ইউরোপের এই তিন জমিদারের আছে শিল্পের আভিজাত্য। আছে বয়সের গৌরব। সত্তর পেরিয়েও তারা আগের মতোই দুনিয়াজোড়া সমান প্রতাপশালী। টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসব সে তুলনায় তাদের প্রায় হাঁটুর বয়সী। ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় এই উৎসব। কানের আছে স্বর্ণপাম, ভেনিসের আছে স্বর্ণসিংহ আর বার্লিনে স্বর্ণভালুক। কিন্তু টরন্টো উৎসব শুধু স্বর্ণ–তৃষার নয়। পুরস্কার এখানে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মুখ্য বিষয় নয়। এই উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ‘পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড’–এর ফয়সালা থাকে দর্শকের হাতেই। উৎসবের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ক্যামেরন বেইলি সোজাসাপ্টাভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘আমরা মনে করি দর্শকই সবচেয়ে ভালো জানেন কোন ছবি ভালো। তাই আমাদের কাছে দর্শকের রায়ই সবার আগে।’
কান চলচ্চিত্র উৎসব সিনেমার দুনিয়ার বাইরের মানুষের ব্যাপারে বরাবরই নিরুৎসাহী। টরন্টো উৎসব সেখানে অনেকখানি উদার।
শত ছবি, শত তারকা
টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসব ছবি নির্বাচনের বেলায়ও তুলনামূলক ‘মুক্তহস্ত’। গত বছর এ উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল ৮৩টি দেশের ৩৪২টি ছবি। এবার প্রদর্শিত হবে ৮৪টি দেশের ৩৩৩টি ছবি। হলিউড ও কানাডিয়ান ছবির পাশাপাশি এই উৎসবে থাকছে সারা বিশ্ব থেকে আসা তথ্যচিত্র, হরর ছবি, ধ্রুপদী এমনকি শিশুতোষ ছবিও।
বড়সড় বাছাই তালিকার কারণেই শুরুতে এ উৎসবকে বলা হতো ‘ফেস্টিভ্যাল অব দ্য ফেস্টিভ্যালস’। বিশ্বের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত ছবিগুলো তখন প্রদর্শিত হতো এ উৎসবে। ‘জনগণের উৎসব’ বলে বিবেচিত এ উৎসবে দর্শকই ঠিক করেন সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারটি যাবে কার হাতে। ‘মাস্টার্স’, ‘গালা প্রেজেনটেশন’, ‘স্পেশাল প্রেজেনটেশন’, ‘প্ল্যাটফর্ম’–এর মতো বড় বিভাগগুলো ঘিরে থাকে দর্শকের মূল আকর্ষণ। এসব বিভাগে গুরুত্ব পায় হলিউডের বড় তারকাবহুল ছবি। ৪৪তম আসরও ব্যতিক্রম নয়।
এবারের টরন্টো উৎসবে তাঁদের নতুন ছবি নিয়ে আসছেন মেরিল স্ট্রিপ, টম হ্যাঙ্কস, রবার্ট ডি নিরো, গ্যারি ওল্ডম্যান, ড্যানিয়েল ক্রেগের মতো মহাতারকারা। বড় তারকাদের মধ্যে আরও আছেন ম্যাট ড্যামন, জেমি ফক্স, ক্রিশ্চিয়ান বেল, অ্যাডাম সেন্ডলার, ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট, নাটালি পোর্টম্যান। আলোচিত তারকাবহুল ছবির তালিকাও সুদীর্ঘ। এর মধ্যে জোকার, জোজো র্যাবিট, আনকাট জেমস, নাইভস আউট, ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি, জাস্ট মার্সি, দ্য গোল্ড ফিঞ্চ, দ্য পার্সোনাল হিস্ট্রি অব ডেভিড কপারফিল্ড—এই ছবির নামগুলো আপাতত মাথায় রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের অর্জন
নানাবিধ কারণে ‘ঢাকাই ছবি’ নামে প্রচলিত এত দিনকার মূলধারার সিনেমা প্রায় ডুবতে বসেছে। দেশের বাইরের বড় উৎসবে বাংলাদেশের ছবির প্রদর্শনী মানেই তাই উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সিনেমার জন্য আরও একটি সুসংবাদ বয়ে এনেছেন নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন। তাঁর পরিচালিত মেড ইন বাংলাদেশ এবার প্রদর্শিত হবে টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবের ‘কনটেম্পরারি ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ বিভাগে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের মোট ৪৮টি দেশের ছবি প্রদর্শিত হবে এই বিভাগে। সাধারণত বিশ্বের নানা প্রান্তের সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুভিত্তিক সিনেমা প্রদর্শিত হয় ‘কনটেম্পরারি ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ বিভাগে। বাংলাদেশের একজন নারী পোশাকশ্রমিকের জীবনসংগ্রাম নিয়ে এই ছবি। বিশ্বের অন্য সব উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কদর কানাডাতেও। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে মেড ইন বাংলাদেশ নামে একটি কানাডিয়ান তথ্যচিত্র বেশ আলোচিত ছিল টরন্টোতে। রুবাইয়াতের একই নামের এই নতুন কাহিনিচিত্রের প্রতি উত্তর আমেরিকার দর্শকের বাড়তি আগ্রহ থাকবে, এটা আশা করাই যায়।
২০১৫ সালে জাহিদুর রহিম অঞ্জন পরিচালিত মেঘমল্লার প্রদর্শিত হয়েছিল টরন্টো উৎসবের ‘ডিসকভারি’ বিভাগে।