অমর সুরস্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০০৫ সালে গঠিত হয় ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন’। এরপর থেকে প্রতিবছর সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক’ দেওয়া হয়ে থাকে। এ বছর শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক পাচ্ছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী এবং স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, স্থপতি জামী আল সাফী।
শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের সদস্য সঙ্গীতা ইমাম প্রথম আলোকে এই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, আলতাফ মাহমুদের অন্তর্ধানের ৪৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে ৩০ আগস্ট বিকেল পাঁচটায় সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ উপস্থিত থেকে পদকপ্রাপ্তদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেবেন।
১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশালের মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে আলতাফ মাহমুদ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’তে নতুন করে সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। তিনবার এ কাজ করার পর নতুন সুর চূড়ান্ত করেন। গানটির প্রথম সুর করেছিলেন আবদুল লতিফ। তাঁকে আলতাফ মাহমুদ নতুন সুরটি শোনান। তিনি বেশ প্রশংসা করেন নবরূপের এ গানটি।
আলতাফ মাহমুদ ১৯টি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এর মধ্যে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলো হলো ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ক্যায়সে কাহু’, ‘কার বউ’, ‘তানহা’, ‘বেহুলা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘দুই ভাই’, ‘সংসার’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘আদর্শ ছাপাখানা’, ‘নয়নতারা’, ‘শপথ নিলাম’, ‘প্রতিশোধ’, ‘কখগঘঙ’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘সুযোরাণী দুয়োরাণী’, ‘আপন দুলাল’, ‘সপ্তডিঙ্গা’ প্রভৃতি।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই শিল্পীকে নতুন পরিচয়ে পায় বাংলাদেশিরা। তিনি তখন একাধারে গানের কাজ করেছেন, পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয় হয়ে ওঠেন। নিজে গেরিলা যোদ্ধা ও সংগঠক ছিলেন। তাঁর বাসায় গেরিলাদের গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তান বাহিনী তাঁকে আটক করে। তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর বাসা থেকে আরও অনেক গেরিলা যোদ্ধাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এঁদের অনেকের সঙ্গে তিনিও চিরতরে হারিয়ে গেছেন। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হতে থাকে, যা অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
দেশ স্বাধীনের পর, ১৯৭৭ সালে মহান এ মানুষকে একুশে পদক দেওয়া হয়। বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান রাখার কারণে তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
২০০৪ সালে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য আবদান রাখায় শহীদ আলতাফ মাহমুদকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) দেওয়া হয়। তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ ও সম্মান করতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন, যা এখন ১৫ বছরে পদার্পণ করছে।
এ পর্যন্ত আলতাফ মাহমুদ পদক পেয়েছেন চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলাম (২০০৫), সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. এনামুল হক (২০০৬), সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন (২০০৭), সংগীতশিল্পী অজিত রায় ও সংগীত পরিচালক খোন্দকার নুরুল আলম (২০০৮), সংগীতশিল্পী সুধীন দাস (২০০৯), স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক বিপুল ভট্টাচার্য (২০১০), সংগীত পরিচালক আলম খান (২০১১), অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও নায়করাজ রাজ্জাক (২০১২), চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার ও সংগীত পরিচালক মো. শাহনেওয়াজ (২০১৩), শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল (২০১৪), সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক (২০১৫), অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (২০১৬), নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের ও শিল্প-সমালোচক মফিদুল হক (২০১৭), সৈয়দ হাসান ইমাম ও ফেরদৌসী মজুমদার (২০১৮)।