বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা বলছেন, প্রয়াত পরিচালক ও লেখক আমজাদ হোসেন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। আমজাদ হোসেনকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস লেখা যাবে না। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র। তাঁর মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তাঁদের বিশ্বাস, নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান তরুণেরাই সেই শূন্যতা পূরণ করবেন।
প্রখ্যাত পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও লেখক আমজাদ হোসেনের প্রতি সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ শনিবার বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে রাখা হয়। সেখানেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এই শ্রদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে আমজাদ হোসেনের মরদেহ নেওয়া হয় কারওয়ান বাজারের এটিএন বাংলা কার্যালয়ে। এরপর নেওয়া হবে এফডিসিতে। সেখানে একটি জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আই কার্যালয়ে।
চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে আমজাদ হোসেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তাঁর জন্মস্থান জামালপুরে। সেখানে আরেকটি জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন তিনি।
আমজাদ হেসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। শহীদ মিনারের সামনে একটি প্যান্ডেলের নিচে আমজাদ হোসেনের কফিনে মোড়া মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হয়। একে একে বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণআজাদী লীগ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন, অভিনয় শিল্পী সংঘ, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ ৩২টি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ফুল দিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। আমজাদ হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের পর দুপুর সাড়ে ১২টায় তাঁর মরদেহ কারওয়ান বাজারের এটিএন বাংলা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আমজাদ হোসেন সম্পর্কে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমজাদ হোসেন একজন বড় চলচ্চিত্রকার ছিলেন। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রের ওপর কাজ করছেন। সব চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে শিক্ষামূলক একটা বক্তব্য তুলে আনতেন। তিনি একজন বড় মাপের লেখকও ছিলেন। আমি সৌভাগ্যবান যে তিনি তাঁর “রাম-রহিম” নামের উপন্যাসটি আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন, যেটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে লেখা। আদর্শিক বিভেদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে কখনো আমাদের ব্যক্তিগত রেষারেষি হয়নি। আমাদের টেলিভিশন নাটকে আমজাদ হোসেনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁর নাটকে নানা অসংগতি উঠে এসেছে। তিনি তাঁর জায়গা তৈরি করে গেছেন। যে শূন্যতা তৈরি হলো, নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান তরুণেরাই সেটি পূরণ করবেন। চলচ্চিত্র, নাটক, তথা সৃষ্টিশীলতার জগতে তাঁরা অবদান রাখবেন।’
শহীদ মিনারে আমজাদ হোসেনকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ও চলচ্চিত্র পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘ষাট ও সত্তরের দশকে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটছে, তখন আমজাদ হোসেনের লেখনী আমাদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। ষাটের শেষভাগে যখন তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়, বড় ভাইয়ের মতো স্নেহশীল একজন মানুষকে পেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ দেশে আমরা তাঁর অবস্থান জেনেছি, সেই সময়ের পরিস্থিতি তিনি সঠিকভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর নাটকে আনন্দের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরির চেষ্টা ছিল। বিষয়বৈচিত্র্য ও নাটকীয় পরিমিতবোধ মিলিয়ে তাঁর চলচ্চিত্রগুলো হয়ে উঠেছিল অনন্য। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, দেশপ্রেমিক ও সৃষ্টিশীল এই মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তাঁকে আমরা ভুলব না।’
এসেছিলেন অভিনেতা ও আবৃত্তিকার সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি বলেন, ‘আমজাদ হোসেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিরাট অবদান রেখে গেছেন। তাঁর চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হলো, আশা করি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা পূরণ করবে।’
আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগটা অত গভীর নয়। আমজাদ গ্রামের মানুষকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, যার জন্য তাঁর চরিত্রগুলো অত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা, ছবিগুলোতে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর অনেক ছবিতে লোকজ সংগীতকে ভেঙে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে, যেটি একটি বিরাট কাজ। ওই সময়টাতে বলিউডের ছবি ও ছবির গান নকল করার একটা প্রবণতা ছিল। তাঁর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমজাদ দেশজ গানগুলোকে আধুনিকায়ন করে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, যেগুলো আজও গাওয়া হয়। তিনি খুব বড় মাপের গীতিকারও ছিলেন। যখন শুধু বিটিভি ছিল, তখন তাঁর নাটক ছাড়া ঈদ হতো না।’
আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন অভিনেতা ও পরিচালক সালাউদ্দিন লাভলু। আমজাদ হোসেন সম্পর্কে তিনি বলেন, শান্ত এবং ধীরস্থির একজন মানুষ ছিলেন আমজাদ হোসেন। এখনো মনে হয় উনি চলে যাননি, আছেন আমাদের মধ্যে৷ উনি একটা প্রতিষ্ঠান। এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, এমন একটা ধারা তৈরি করে গেছেন যে বাংলাদেশের দর্শকদের বুকের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন। ওনার সৃষ্টিগুলো একদমই ব্যতিক্রম। নতুন প্রজন্মের অনেকের হয়তো সেগুলো দেখার সুযোগ হচ্ছে না, কিন্তু আমরা যখন তরুণ ছিলাম ওনার দুর্দান্ত চলচ্চিত্র দেখেই চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়েছি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করব বলে আশা করেছি। তাঁর মতো মানুষদের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।’
প্রয়াত এই গুণী মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন অভিনেত্রী ও বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া প্রাচী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একটা কথাই বলতে চাই, আগামী এক শ-দুই শ বছরের চলচ্চিত্রের ইতিহাস লিখতে হলে আমজাদ হোসেনের চলচ্চিত্রের কথা লিখতে হবে। আমাদের ভালো ছবিগুলোর কথা লিখতে গেলে সেই তালিকায় আমজাদ হোসেনের কমপক্ষে ১০টি ছবি থাকবে। একজন মেধাবী চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালককে আমরা হারিয়েছি। তাঁর চলে যাওয়াটা একটা বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করল। ওনার জায়গা কেউ পূরণ করতে পারবে না। অনেক চলচ্চিত্রকার আসবেন, কিন্তু তাঁর জায়গা পূরণ হবে না।’
এসেছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। এই অধ্যাপক বলেন, ‘দেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও একজন বড় লেখক আমজাদ হোসেন এ দেশের সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে যে অবদান রেখেছেন, তা অবিস্মরণীয়। তাঁর চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। আসলে পৃথিবীতে কোনো শূন্যতা নেই, একজন যাবেন আরেকজন আসবেন। হয়তো তাঁর মতো মেধাবী হবেন না, অন্য কারোর মতো বা নিজের মতো হবেন, অন্য দিকে অন্য ধারায় তৈরি হবেন। তাঁর চেয়ে বেশি প্রতিভাবান মানুষও তৈরি হতে পারেন।’
আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, ‘আমজাদ হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক ও বাহক। সারাটি জীবন তিনি দেশ ও দেশের চলচ্চিত্রের সেবা করেছেন। কজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। জাতীয়তাবাদী শক্তি তার এক বড় সিপাহশালারকে হারাল। আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি।’
নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমজাদ হোসেন ১৯৬০ সাল থেকে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত। ক্রমাগত জীবনসংগ্রাম করেছেন, তবু চলচ্চিত্র থেকে অব্যাহতি নেওয়ার কথা ভাবেননি। তাঁকে আমি একজন সহকর্মী, গুরু ও বড় ভাই হিসেবে পেয়েছি। নতুন প্রজন্ম তাঁর থেকে যে শিক্ষাটা নিতে পারে, সেটি হচ্ছে লেগে থাকতে হয়, যেকোনো কিছুর পেছনে লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লেগে ছিলেন।’
প্রয়াত পরিচালক ও লেখক আমজাদ হোসেনের ছেলে সোহেল আরমান বলেন, ‘আমার বাবা বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না, সাধারণ মানুষের মতো চলতেন। সবাই দোয়া করবেন, বাবার আদর্শে যেন চলতে পারি। আমার মনে হয়, যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তিনিও তত দিন বেঁচে থাকবেন। সবাই দোয়া করবেন, তিনি যেন জান্নাতবাসী হন।’
আমজাদ হোসেনের আরেক ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল বলেন, ‘আমার বাবাই প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। ছবিটির নাম ছিল “বাংলার মুখ”। সেই ছবির পোস্টার আমরা দেখেছি। কিন্তু পরে ছবিটি আর আলোর মুখ দেখেনি। বাবা একজন নির্লোভ মানুষ ছিলেন। মানুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভালোবাসা ছিল। তাঁর চেতনা, তাঁর কলম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেভাবে চলেছে—অপূর্ব! সবাই দোয়া করবেন, তাঁর যেন বেহেশত নসিব হয়।’
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় দুপুরে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আমজাদ হোসেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। এর আগে গত ১৮ নভেম্বর ব্রেনস্ট্রোক করে রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আমজাদ হোসেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় ২৮ নভেম্বর রাতে তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ব্যাংককে নেওয়া হয়।