>
বিনোদনের বাজারে জাপান শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তাদের অ্যানিমে শিল্প দিয়ে। দেশের সীমানা পেরিয়ে এর আধিপত্য এখন সারা বিশ্বে। বাংলাদেশেও রয়েছে অ্যানিমের বেশ বড়সড় ভক্তমহল। আবার অনেকেই অ্যানিমে দুই চোখে দেখতে পারেন না। অনেকে মনে করেন, এটা নাকি বাচ্চাদের জিনিস! আমরা তাই এবার অ্যানিমের জগতে ঢুকে যাব। বিনোদনজগতের শক্তিশালী এই ধারা নিয়ে থাকবে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন।
মাঙ্গা থেকে অ্যানিমে
জাপানে নাকি টয়লেট পেপারের চেয়েও বেশি কাগজ লাগে মাঙ্গার জন্য। মাঙ্গা কী? সহজ ভাষায় মাঙ্গা হচ্ছে জাপানে তৈরি একধরনের কমিক বা গ্রাফিক নোভেল। জাপানে ছেলে–বুড়ো সবাই মাঙ্গা পড়ে। ১৯৫০ সালের কাছাকাছি থেকে মাঙ্গা জাপানের প্রকাশনাশিল্পের বড় অংশ হয়ে ওঠে। ১৯৯৫ সাল নাগাদ তো মাঙ্গা মার্কেট জাপানে প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের হয়ে পড়েছিল, যা আস্তে আস্তে আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারেও চলে আসে। অ্যানিমের লেখায় মাঙ্গা টেনে আনার কারণ হচ্ছে, যদি কোনো মাঙ্গা সিরিজ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে, তবে তা অ্যানিমেটেড হতে পারে। অর্থাৎ মাঙ্গা থেকেই তৈরি হয় অ্যানিমে। এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া অধিকাংশ অ্যানিমের মূল ভিত্তিই ছিল মাঙ্গা।
শুরুর কথা
অ্যানিমে মূলত ‘অ্যানিমেশন ইন জাপান’–এর সংক্ষিপ্ত রূপ। কাতশুদৌ শাশিন হচ্ছে প্রথম অ্যানিমে চলচ্চিত্র। ১৯০৭ সালে বানানো এই চলচ্চিত্র মাত্র ৩ সেকেন্ডের। কে বানিয়েছিলেন, তা এখনো অজানা। এরপর ১৯১৭ সালে জাপানি শিল্পী শিমোকাওয়া ওটেন, জুনিচি কাওচি ও সেটারো কিটাইয়ামার হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় মূল অ্যানিমেশন ইন জাপানের। শিমোকাওয়ার বানানো অ্যানিমেটি ছিল ইমোকাওয়া মুকুজো জেনকানবান নো মাকি।
কিন্তু ১৯২৩ সালের দিকে আমেরিকায় শুরু হয় ‘দ্য ওয়াল্ট ডিজনি’ কোম্পানির যাত্রা। ডিজনির অ্যানিমেশন ছিল রঙিন ও উন্নত। জাপানিরা ঠিক পেরে উঠছিল না ডিজনির সঙ্গে। ফলে জাপানের শিল্পীরা পিছিয়ে আসেন। এরপর ১৯৩৯ সালের দিকে জাপানের অ্যানিমেশন নির্মাতারা কোমর বেঁধে মাঠে নামেন অ্যানিমে নিয়ে। হাজার হাজার কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমে বড় হতে থাকে জাপানের অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি। ১৯৫৮ সালের দিকে প্রথম রঙিন ও আধুনিক অ্যানিমে দ্য টেল অব দ্য হোয়াইট সারপেন্ট তৈরি করে জাপান। ১৩ হাজার শ্রমিকের ৮ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ছিল এটি। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বিভিন্ন প্রতিকূলতাও শক্ত হাতে দমন করেছেন জাপানের অ্যানিমে বাজারের শিল্পীরা।
কেন এই জনপ্রিয়তা
২০১৬ সালের কথা। জাপানের অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি ১৭৭০ কোটি ডলারের (রাজস্ব আয়সহ) রেকর্ড করে বসে। ‘কিমি নো না ওয়া’ (ইয়োর নেম), স্পিরিটেড অ্যাওয়ে, আকিরা, নারুতো, ওয়ান িপস–এর মতো রেকর্ডভাঙা অ্যানিমে তো সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে জাপানের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে বসে আছে অ্যানিমে আর মাঙ্গা। বিখ্যাত অ্যানিমেবিশারদ তাকামাশা সাকুরাই মনে করেন, জাপানের অ্যানিমে এই ধারণা ভেঙে দিয়েছে যে এটি শুধু বাচ্চাদের দেখার জিনিস নয়।
অ্যানিমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হলো এর হরেক রকমের ঘরানা। নিত্যদিনের ছোট–বড় বা তুচ্ছ—সব কাহিনি নিয়েও অ্যানিমে আছে। আপনি ঠিক যে ধরনের গল্প দেখতে চাচ্ছেন, তাই-ই অ্যানিমের মধ্যে খুঁজে পাবেন। এ ছাড়া দর্শকমনকে টানার কারণ অ্যানিমের গল্প বা ঘটনাপ্রবাহ। প্রায় অ্যানিমেতেই ভক্তরা নিজেদের মূল চরিত্রটির সঙ্গে জুড়ে দিতে পারেন।
সব অ্যানিমেই কার্টুন, কিন্তু সব কার্টুনই অ্যানিমে না। কার্টুনের গল্পগুলো বাচ্চাদের উপযোগী করে বলা হয়। অ্যানিমেটেড করাও হয় সেভাবে। কিন্তু অ্যানিমে এমনভাবে তৈরি হয় যে যেকোনো বয়সী দর্শকই তা দেখতে পারেন।
অ্যানিমের প্রতিটি চরিত্রই কাল্পনিক বা বানানো। মাকোতো শিনকাই বা ইউতাকা নাকামুরা–এর মতো পরিচালকদের ভক্তমহল সৃষ্টি হয়ে গেছে অ্যানিমে থেকেই। আবার অ্যানিমের মিউজিকও কোনো অংশে কম যায় না। প্রতিটি অ্যানিমেরই আলাদা থিম সং থাকে। এমনকি জাপানে ব্যান্ডগুলোও সৃষ্টি হয় অ্যানিমের জন্যই।
জাপান ও অ্যানিমে
জাপানের সব বয়সী সাধারণ মানুষ যে কত বড় অ্যানিমে–ভক্ত, তা তাদের কাজকর্মেই বোঝা যায়। প্রতি সপ্তাহে ৪০টির বেশি অ্যানিমে মুক্তি পায় জাপানে। সেখানে ভাস্কর্য থেকে শুরু করে রেলস্টেশন, পথে-ঘাটে অ্যানিমের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। যেমন জাপানের ওইডাইবাতে গেলে দানবাকারের এক রোবট অ্যানিমে চরিত্র আপনাকে স্বাগত জানাবে।
আমাদের দেশে অ্যানিমেকন বা এ ধরনের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আর জাপানের অ্যানিমে কনভেনশনগুলোকে অ্যানিমে ইউটোপিয়াও বলা যায়। ‘অ্যানিমে জাপান’–এর অনুষ্ঠানে প্রতিবছর অংশ নেয় দেড় লাখের মতো মানুষ, মাত্র তিন দিনে!
বাংলাদেশে অ্যানিমে নিয়ে আইফ্লিক্স
আমাদের দেশেও অ্যানিমের দর্শক মহল তৈরি হয়েছে অনেক দিন হলো। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের যেমন খুশি তেমন সাজো বা কসপ্লেতে কিশোর–কিশোরী, তরুণেরা কানেকি (টোকিও ঘুল), এরেন (অ্যাটাক অন টাইটান), কিরা (ডেথ নোট), নারুতোর মতো চরিত্রগুলোর বেশে সাজছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলা সাবটাইটেলসহ বাংলাদেশ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আইফ্লিক্স নিয়ে এসেছে অ্যানিমে। চাইলে দেখে নিতে পারেন বর্তমানে আইফ্লিক্সের সবচেয়ে বেশি দেখা ৫টি অ্যানিমে, ‘রেন্টাল ম্যাগিচা’ (ফ্যান্টাসি/কমেডি), ‘ফুল মেটাল প্যানিক: বয় মিট গার্ল’ (অ্যাকশন), ‘উশিও অ্যান্ড তোরা’ (অ্যাকশন/কমেডি), ‘মব সাইকো ১০০’ (অ্যাকশন) আর ‘ওয়ান পাঞ্চ ম্যান’ (অ্যাকশন/অ্যাডভেঞ্চার)।