দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত শিক্ষার্থী পড়েন, তার একটি বড় অংশই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুবই ভালো করছে। এমনকি ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি থাকছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি করার সুযোগ নেই। শিক্ষার মান ও গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিতে হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পিএইচডির সুযোগ দিতে হবে। তবে সবাইকে না দিয়ে মানদণ্ড ঠিক করে দিয়ে যারা যোগ্য, তাদের এই সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। বন্ধ দুয়ার খোলা দরকার।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) জিপিএইচ ইস্পাত-প্রথম আলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি উৎসবে এক সংলাপ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব কথা বলেন। আজ রোববার শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী এই ভর্তি উৎসব। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি-সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি এ উৎসব থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার খোঁজখবরও জানা যাচ্ছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় উৎসবস্থলেই ছাড় দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছে। এই ভর্তি উৎসবে ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইএমকে সেন্টারসহ মোট ৪৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্টল থেকে ভর্তির তথ্য, বৃত্তির খবর এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কেও জানতে পারছেন।
উৎসবে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ থাকা দরকার। মানদণ্ড ঠিক করে দিয়ে এটি করা যায়। তবে ঢালাওভাবে দেওয়ার দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথমে নিজেরাই একটি মানদণ্ড ঠিক করে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। যারা এই মানদণ্ড পূরণ করবে না, তাদের সেই সুযোগ দেবে না। কিন্তু যারা করবে, তাদের আটকে রাখা ঠিক নয় বলে মনে করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তসহ একটি অবস্থানপত্র তৈরি করা জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তিনটি ধারণা ছিল। একটি হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজাচ্ছে? কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে, চাহিদা আছে বলেই তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় ধারণাটি ছিল, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বোধ হয় বড়লোকের ছেলে-মেয়েরাই পড়েন। কিন্তু এখন বাস্তবতা হলো ভিন্ন। আরেকটি ধারণাটি ছিল, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মান নেই। কিন্তু এখানেও বাস্তবতা ভিন্ন। অনেকগুলোর মান ভালো আছে, সেটাই দেখা যাচ্ছে।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কী করে যেন প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে। এটা হওয়া উচিত ছিল না। এটাই দুঃখের জায়গা। চাহিদার জায়গা থেকে তৈরি হয়েছে, তাহলে কেন প্রতিপক্ষ ভাবা হয়। এখানে কাজ করার জায়গা আছে।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘দিন শেষে সরকারি-বেসরকারি নয়, এটি আমাদের দেশ, আমাদের সন্তান, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এই চিন্তা থেকে দেখতে হবে।’
মানদণ্ডের আলোকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আতিকুল ইসলাম। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংয়ে দুটি প্রশ্ন করে। একটি স্নাতক শিক্ষার্থীর অনুপাতে পিএইচডির শিক্ষার্থী কত? কিন্তু সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শূন্য নম্বর পায়। আরেকটি শিক্ষকদের সঙ্গে পিএইচডি শিক্ষার্থীর অনুপাত কত। সেখানেও শূন্য নম্বর। তার মানে, ‘হাত-পা বেঁধে’ প্রতিযোগিতায় যেতে হয়। যদি পিএইচডির সুযোগ থাকত, তাহলে তো কিছু না কিছু নম্বর পাওয়া যেত। পিএইচডির শিক্ষার্থী না থাকায় গবেষণা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় বলে জানান তিনি।
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য সহিদ আকতার হোসেন অভিযোগ করেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিমাতা সুলভ আচরণ করা হচ্ছে। শিক্ষার মান এগিয়ে নিতে হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক আক্ষেপ করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে পিএইচডি হয়। কিন্তু এখানে (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) পারছেন না। তবে তিনি আশা করেন, এর উত্তরণ হবে।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্য ইমরান রহমান বলেন, ‘আমরা পিএইচডি ডিগ্রি দিতে পারছি না বলে একটি জায়গা আটকে আছি। একটি ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে দিতে হবে। সেটাই নির্ধারণ করবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়, কোন বিভাগ পিএইচডি দিতে পারবে।’
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আবুল কাশেম মিয়া বলেন, চ্যালেঞ্জ হলো আস্থার জায়গা। অথচ কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির র্যাঙ্কিংয়ের তথ্য দেখলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তার মধ্যে আটটি পাবলিক, সাতটি বেসরকারি। তার মানে, প্রায় সমান। তাহলে আস্থার জায়গায় সংকট থাকার কথা নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুযোগ না থাকার অবস্থাটিকে ‘হাত-পা বেঁধে দিয়ে সাঁতার’ কাটার সঙ্গে তুলনা করেন আবুল কাশেম মিয়া। তিনি বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায় রাজি। কিন্তু কোথাও যেন একটি...ওখান থেকে হচ্ছে না। তাঁর পরামর্শ, সুন্দর একটি গাইডলাইন তৈরি করে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। পাবলিক ও বেসরকারি, সবার জন্যই সমান গাইডলাইনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জের কথা জানান কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ হলো, সরকার বিশ্বাস করছে না। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ইউজিসি বিশ্বাস করছে না। তিনি বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, এখানে যারা যোগ্য, তাদের এই সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমে ১০-১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া যেতে পারে, যারা পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার মতো যোগ্য। আস্থার ঘাটতির জায়গায় হাত দিতে হবে। তাহলে গবেষণার খাতটি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অধ্যাপক আরশাদ মোমেন বলেন, ‘মানদণ্ড ঠিক করে সুযোগটি দিতে হবে। যে কমিটি করার করুন, প্রয়োজনে বিদেশি অধ্যাপককেও কমিটিতে রাখুন। কিন্তু সুযোগ দেওয়ার এখনই সময়।’
তেজগাঁও কলেজের অধ্যক্ষ হারুন অর রশীদ বলেন, পিএইচডি যেনতেন ডিগ্রি নয়। তাই যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে যোগ্যতা অর্জন করে তা প্রমাণ করতে পেরেছে, সরকার ও ইউজিসির সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির সুযোগ দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন না।
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডার) বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মুজিব খান বলেন, অনেকে ধারণা করছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুযোগ দেওয়া হলে পিএইচডির নামে বাণিজ্য হবে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক, যাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, তাঁরা কিন্তু পিএইচডির সুপারভাইজার ছিলেন, পিএইচডি করিয়েছিলেন। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না।
প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসানের সঞ্চালনায় এই শিক্ষা সংলাপে আরও বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য আবদুর রব, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য এম রেজওয়ান খান, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য কামরুল আহসান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ বি এম রাশিদুল হাসান, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য মো. ফৈয়াজ খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ডেভিড ডাউডল্যান্ড, মালয়েশিয়ার ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাসের প্রভোস্ট চ্যান জো জিম।