বিনা মূল্যের বই

নতুন বইয়ে ভুলভ্রান্তি, ছাপার মান নিয়ে প্রশ্ন

পুরোনো কিছু ভুল সংশোধন করা হয়নি। এখনো সব শিক্ষার্থী সব বই পায়নি।

নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ২০০ পৃষ্ঠায় একটি অংশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থার ধরন কী হবে, এই সম্পর্কে তখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিনই ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় দীর্ঘ আলোচনার পর “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ” জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই দিনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।’

বইয়ে এমন তথ্য থাকলেও আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও একজন ইতিহাস গবেষকের সঙ্গে কথা বলে এবং সেই সময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে ওই সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছিলেন ওই সময়ের নতুন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

* প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের বই হাতে পেয়েছে। * অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই। * কিছু কিছু মুদ্রণকারী বই ছাপিয়েছেন অতি নিম্নমানের কাগজে।

এমন ভুল নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষে বিনা মূল্যের বই। শুধু এই বইয়েই নয়, আরও একাধিক বইয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য আছে। গতবার থাকা কোনো কোনো ভুলও এবার রয়ে গেছে। এবার পাঠ্যবইয়ের মানও আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এ ছাড়া ১ জানুয়ারি সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে বই বিতরণ করা হলেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সব বই হাতে পায়নি।

বই ছাপার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নানা জটিলতায় শেষ সময়ে বই পাওয়ার জন্য এবার মানে ছাড় দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) লক্ষ্য ছিল, যেকোনোভাবেই হোক, নতুন শিক্ষাবর্ষে উৎসব করে যেন বই দেওয়া যায়। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন বছরের শুরুর দিন অন্তত একটি বা দুটি হলেও বই পায়। সেই লক্ষ্য পূরণ হলেও শিক্ষার্থীরা আগের বছরগুলোর মতো মানসম্মত বই পায়নি।

বই ছাপার সঙ্গে সম্পৃক্ত সূত্রগুলো বলছে, ভালো মানের পাল্পের (কাগজ তৈরির মণ্ড) সংকটের অজুহাতে বইয়ের উজ্জ্বলতার ক্ষেত্রে ‘অলিখিতভাবে’ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। কিছু কিছু মুদ্রণকারী ‘অতি নিম্নমানের নিউজপ্রিন্ট জাতীয় কাগজ’ দিয়ে বই ছাপিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আসলে এবার মান দেখা হয়নি, দেখা হয়েছে সংখ্যা।

এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৬ লাখের বেশি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বই দেওয়া হচ্ছে।

এসব বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। এরপর আরও দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলেও তাঁরা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে চাননি।

পুরোনো ভুল সংশোধন হয়নি

এবার শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীরা দুই ধরনের বই হাতে পেয়েছে। এর মধ্যে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে নতুন বই হাতে পেয়েছে। আর অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে বই হাতে পেয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণয়ন করা বইগুলোর মধ্যে কোনো বইয়ে এখনো ভুলভ্রান্তি রয়ে গেছে। যেমন নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যাবিষয়ক অংশে প্রথম লাইনে বলা হয়েছে, ‘২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল।’ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাত থেকেই নিরীহ বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। যদিও আরেকটি বাক্যে ২৫ মার্চের রাতে অত্যাচারের কথা বলা আছে, কিন্তু প্রথম লাইনটি যেভাবে দেওয়া হয়েছে, তাতে বিভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে।

এখনো সব বই পায়নি শিক্ষার্থীরা

গতকালও শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পায়নি। রাজধানীর বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি ভার্সনের এক ছাত্র জানাল, সে প্রথম দিন বাংলা ও ইংরেজি বই পেয়েছে। বাকি বই কবে পাবে, জানে না।

রাজধানীর সরকারি সায়েন্স হাইস্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রের বাবা জানালেন, তাঁর সন্তান সাতটি বই হাতে পেয়েছে। এই শ্রেণিতে মোট বই ১৪টি।

বই ছাপার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিকের প্রায় ২৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ১৯ শতাংশের মতো বই ছাপাই হয়নি। মাধ্যমিকের সব বই পেতে এই মাস পুরোটাই লেগে যেতে পারে। আর প্রাথমিকের সব বই পেতে কমপক্ষে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত লাগবে। আরও বেশিও লাগতে পারে।