শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝা থাকছেই

নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলেও শিশুদের পাঠ্যবইয়ের অতিরিক্ত বই পড়াচ্ছে বিদ্যালয়গুলো, যা আইনে নিষিদ্ধ।

শিশুর কাঁধে চেপে বসেছে ব্যাগের বোঝা

শিশুদের জন্য প্রথম শ্রেণিতে সরকার-নির্ধারিত পাঠ্যবই তিনটি। তবে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় আরও চারটি বই। সব মিলিয়ে তাদের সাতটি বই পড়তে হয়।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পাশেই একটি বইয়ের দোকান রয়েছে। ১৫ জানুয়ারি দোকানটিতে গিয়ে জানা যায়, প্রথম শ্রেণিতে অতিরিক্ত চারটি বইয়ের মধ্যে বাংলা বিষয়ে দুটি ও ইংরেজির দুটি। এই চার বই ও স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত খাতা মিলিয়ে দাম ৯৮০ টাকা। অভিভাবকদের তা বাধ্যতামূলকভাবে কিনতে হচ্ছে।

শুধু প্রথম শ্রেণি নয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই রয়েছে। কাছাকাছি দূরত্বের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলেও পড়ানো হয় অতিরিক্ত বই। শুধু এ দুটি স্কুল নয় ঢাকা ও বড় শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই বাড়তি বই পড়তে বাধ্য করা হয় শিক্ষার্থীদের। যদিও আইনে এটি নিষিদ্ধ। তারপরও বছরের পর বছর ধরে শিশুদের অতিরিক্ত বই পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।

পড়াশোনাকে আনন্দময় করার জন্য এ বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এই তিন শ্রেণিতে দেওয়া হয়েছে নতুনভাবে লেখা বই। তারপরও বন্ধ হয়নি অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা। রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রেণিভেদে দুই থেকে আটটি অতিরিক্ত বই পড়ানো হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অতিরিক্ত বই বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে কোনো কোনো স্কুল নিজেরা বইয়ের ব্যবসা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল সরাসরি বই বিক্রি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ের দোকান ঠিক করে দেয়, যেখান থেকে সুবিধা পায়। বাড়তি বই পড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষকদের কোচিং–বাণিজ্যও উৎসাহিত হয়।

শিক্ষার্থীর বয়স ও বিকাশের কথা বিবেচনা করে পাঠ্যবই ও পাঠগুলো নির্ধারণ করা হয়। এর অতিরিক্ত বই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হলে তা ক্ষতির কারণ হয়।
অধ্যাপক এম তারিক আহসান, সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কমিটি

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল শিশুদের অতিরিক্ত বই পড়ানো কতটা দরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীর বয়স ও বিকাশের কথা বিবেচনা করে পাঠ্যবই ও পাঠগুলো নির্ধারণ করা হয়। এর অতিরিক্ত বই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হলে তা ক্ষতির কারণ হয়। তিনি বলেন, শিশুকে আনন্দ দেয়, এমন সুখপাঠ্য বই শিশুরা পড়তে পারে। কিন্তু অতিরিক্ত পাঠ্যবই যেগুলো মুখস্থ করতে হয়, তা বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো যাবে না। এ চর্চা বন্ধ করতে হবে।

আইনে কী আছে

কোন শ্রেণিতে কয়টি বই পড়ানো হবে, তা নির্ধারণ করে দেয় এনসিটিবি। সেটি ঠিক করার জন্য শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটিও রয়েছে। প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দেয় সরকার।

এনসিটিবির আইনে বলা আছে, বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত নয় অথবা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অনুমোদিত নয়, এমন কোনো পুস্তককে কোনো বিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না। কেবল সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোনো বিদ্যালয় বা কোনো শ্রেণির বিদ্যালয়কে এ ধারার প্রয়োগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আইনের প্রয়োগ থেকে অব্যাহতি নেওয়া ছাড়াই স্কুলগুলোতে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হচ্ছে। সমস্যাটি নতুন নয়। অনেক বই ও খাতা নিয়ে ছোট্ট শিশুদের স্কুলে যেতে হয় বলে ২০১৬ সালে উচ্চ আদালত একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখানে শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই পড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, এটি আগে থেকেই হয়ে আসছে। তিনি নতুন কোনো কিছু করেননি। তবে তিনি মনে করেন, বেশি পড়লে সমস্যা নেই; বরং দক্ষতা বাড়ে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিশুদের অতিরিক্ত বই পড়ালেই দক্ষতা বাড়ে না; বরং অনেক সময় শেখার প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয়।

কী বলছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা

পাঠ্যবইয়ের অতিরিক্ত বই পড়ানো বন্ধের দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবির। এসব সংস্থার কার্যালয়ের কাছের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়ানো হয় অতিরিক্ত বই। জিজ্ঞাসা করা হলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রতিবছর একই রকম কথা বলেন।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত বই চাপিয়ে দিচ্ছে, তারা শুধু বেআইনি কাজই করছে না, শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ তৈরি করছে। একইভাবে বৈষম্যেরও সৃষ্টি করছে।

তাহলে বেআইনি কাজটি বন্ধ করা হচ্ছে না কেন, এ প্রশ্নের জবাবে মশিউজ্জামান বলেন, এনসিটিবির তো সারা দেশে কার্যালয় নেই। এগুলো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর দেখে।

মশিউজ্জামানের এ বক্তব্যের ভিত্তিতে যোগাযোগ করা হয় মাউশির পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য হলো, শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এনসিটিবি যেসব বই নির্ধারণ করবে, এর বাইরে বাধ্যতামূলকভাবে কোনো পাঠ্যবই পড়ানোর সুযোগ নেই। যদি কেউ অতিরিক্ত বই পড়ায় এবং তা নিয়ে অভিযোগ করা হয়, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মাউশির কার্যালয় থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত স্কুলেই অতিরিক্ত বই পড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হলে বেলাল হোসাইন বলেন, তিনি খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

‘অভিভাবকেরা অসহায়’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলগুলো অনেক সময় অতিরিক্ত বই পড়ায় অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদের আলাদা হিসেবে উপস্থাপনের জন্য। আলাদা দেখিয়ে তারা বাড়তি বেতন ও ভর্তি ফি নেয়। অতিরিক্ত বই পড়ানোর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে বৈষম্যও তৈরি করা হয়। কোনো স্কুলে শিশুরা প্রথম শ্রেণিতে তিনটি বই পড়ে, কোনো স্কুলে সাতটি। যদিও এত বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

রাজধানীর মিরপুরের একটি স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত বই পড়ানোর বিরুদ্ধে অভিভাবকদের আসলে কিছুই করার নেই। তাঁরা অসহায়। এটি বন্ধ করতে হলে সব স্কুলে একসঙ্গে বন্ধ করতে হবে।