প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক বিষয়

যেভাবে যশোরের শিক্ষকদের তৈরি প্রশ্নে পরীক্ষা হলো ঢাকা বোর্ডে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় বিতর্কিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও চার পরিশোধনকারীকে (মডারেটর) চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁরা সবাই যশোর শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক।

প্রশ্ন উঠতে পারে, পরীক্ষাটি ঢাকা বোর্ডের, সে ক্ষেত্রে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন কলেজের শিক্ষকেরা কীভাবে এখানে যুক্ত হলেন? এর উত্তর হলো, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় যে নিয়ম আছে, সে জন্য এমনটি হয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার আজ মঙ্গলবার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের নিয়মটি বলতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের করা প্রধান প্রশিক্ষকদের (মাস্টার ট্রেইনার) তালিকা প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডে দেওয়া আছে। এই তালিকা থেকে পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগে প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের জন্য একেকটি বিষয়ের জন্য চারজন প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী শিক্ষক ঠিক করা হয়। তাঁরা পৃথকভাবে চার সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে সিলগালা খামে সংশ্লিষ্ট বোর্ডে জমা দেন। একেকটি বিষয়ের জন্য আবার চারজন পরিশোধনকারী থাকেন। তাঁরা ওই চার সেট প্রশ্নপত্র গোপনীয়তার সঙ্গে যাচাই করেন। তাঁরা ইচ্ছা করলে সেসব প্রশ্ন পুরোটাই রাখতে পারেন বা আংশিক রেখে কিছু সংযোজন করতে পারেন। ভুল-ত্রুটি থাকলে সংশোধন করেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারীর করা প্রশ্নপত্র মানসম্মত না হলে পরিশোধনকারীরা নতুন করে প্রশ্নপত্রও প্রণয়ন করতে পারেন, এই স্বাধীনতাও তাঁদের দেওয়া আছে। এবার বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী যে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেছেন, সেটিই রাখা হয়েছে, কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।

নিয়মটি বলতে গিয়ে চেয়ারম্যান আরও বলেন, এভাবে যাচাই-বাছাই করে চার সেট প্রশ্নপত্র সিলগালা খামে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে দিয়ে যায়। সেগুলো বোর্ডে ট্রাংকে গোপনীয়তার মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে প্রতিটি বোর্ড চার সেট করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে। বর্তমানে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। এই হিসাবে একটি বিষয়ের জন্য মোট ৩৬ সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। কাজটি এমনভাবে করা হয়, প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও পরিশোধনকারী ছাড়া আর কারও পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। এমনকি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকও তা দেখতে পারেন না।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আরও জানান, এরপর নির্ধারিত একটি সময়ে প্রতিটি বোর্ডের প্রশ্নপত্র কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকেরা ট্রাংকে করে সেগুলো ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে (আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ের দায়িত্বে) আনেন। এরপর সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে প্রতিটি বোর্ড নিজ বোর্ডের করা চার সেট প্রশ্নপত্র বাদে বাকি ৩২ সেট প্রশ্নপত্র থেকে লটারির মাধ্যমে দুই সেট প্রশ্নপত্র বেছে নেয়। এগুলোর একেকটির খামের ওপর ক সেট, খ সেট লিখে রাখা হয়। এই বাছাইয়ের সময় প্রশ্নপত্র দেখার কোনো সুযোগ থাকে না। প্রতিটি বোর্ডের দুই সেট করে প্রশ্নপত্র তখন সিলগালা খামে করে ছাপার জন্য সরাসরি বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। এই কাজের জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও পরিশোধনকারীরা নির্ধারিত হারে সম্মানী পান। এবার লটারির মাধ্যমে যশোর বোর্ডের করা প্রশ্নপত্র ঢাকা বোর্ডের ভাগে পড়ে।

জানা গেছে, বিজি প্রেস থেকে ছাপার পর তা স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়। জেলা সদরের ক্ষেত্রে সাধারণ ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র রাখা হয়। আর উপজেলার ক্ষেত্রে সাধারণত থানায় রাখা হয়। প্রশ্নপত্রগুলো ঠিকঠাক গেল কি না, সেটি উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে দেখভাল করা হয়। এরপর যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা থাকে, সেই বিষয়ের দুই সেট প্রশ্নপত্রই পরীক্ষার কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তখন পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে কেন্দ্রসচিবকে জানানো হয়, কোন সেট প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে। তারপর সেই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সূত্রমতে, সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ কোনো বক্তব্য যেন প্রশ্নপত্রে না থাকে, সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময়ই লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্নপত্র দেখার কোনো সুযোগ থাকে না। তাই তাৎক্ষণিকভাবে সেটি বোঝা যায় না।

বিতর্কিত প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেটরদের যে শাস্তি হতে পারে
গত রোববার অনুষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে একটি প্রশ্নের উদ্দীপক (সৃজনশীল প্রশ্নের একটি অংশ) হিসেবে এমন বিষয় বেছে নেওয়া হয়, যা খুবই সংবেদনশীল। এতে সাম্প্রদায়িক উসকানি রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। অভিযোগ ওঠে, বাংলা প্রথম পত্রের ওই প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকেও লেখালেখি হচ্ছে।

বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও মডারেটরকে খুঁজে বের করার কাজে নামে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। আজই তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্ন প্রণয়নকারী ঝিনাইদহের মহেশপুরের ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। আর চার পরিশোধনকারী হলেন নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দিন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ এবং কুষ্টিয়া ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।

এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বলেন, যেহেতু প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও পরিশোধনকারী সবাই যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন। তাই যশোর বোর্ড একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। নিয়মানুযায়ী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এই তদন্ত কমিটি সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিলে মন্ত্রণালয় তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে।

জানা গেছে, যশোর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক এম রব্বানীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কী ধরনের ব্যবস্থা হতে পারে, জানতে চাইলে তপন কুমার সরকার বলেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলার ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে মন্ত্রণালয়। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এমপিও (বেতন বাবদ সরকারি টাকা) বাতিল বা স্থগিত হতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষা বোর্ড যেটি করতে পারে তা হলো, ওই সব শিক্ষককে আজীবনের জন্য বোর্ডের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধনসহ বোর্ডের কাজে নিষিদ্ধ করতে পারে।