দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভাস্কর এবার ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে

ভাস্কর ভট্টাচার্য
ছবি: সংগৃহীত

ভাস্কর ভট্টাচার্য কী কী দক্ষতা অর্জন করেছিলেন? তিনি কীভাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন? এখন থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। ভাস্কর ভট্টাচার্য একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি। সফল ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ছোট একটি কেস স্টাডি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২) ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকে।

‘প্রযুক্তির আলোয় দৃষ্টি জয়ী ভাস্কর’ শিরোনামে পাঠ্যপুস্তকে ভাস্কর ভট্টাচার্যের কেস স্টাডিটি ছাপা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভাস্কর ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কথা পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই পেয়েছে, এটা আমার এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অনেক বড় একটি পাওয়া। এর চেয়ে বড় কথা হলো, শিশুদের সামনে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী একজন ব্যক্তিকে সফল ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে শিশুদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। এ শিক্ষা বাস্তব জীবনেও শিশুরা চর্চা করবে।’

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ভাস্কর ভট্টাচার্য একজন অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আইসিটি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্পের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (অ্যাকসেসিবিলিটি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতার কারণে ভাস্কর ভট্টাচার্যের একসময় পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাঁকে স্কুলে ভর্তি করতে রাজি ছিল না। সেই ভাস্কর ভট্টাচার্য এখন পাঠ্যবইয়ের পাতায়—এ বিষয়কে ভাস্কর ভট্টাচার্য বড় অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

২০২১ সালে বিশ্বের ৩০ প্রভাবশালী প্রতিবন্ধী নেতার একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ‘ডি-৩০ ডিজঅ্যাবিলিটি লিস্ট-২০২১’ সম্মাননা পান ভাস্কর।

ভাস্কর বলেন, ছোটবেলায় নতুন বই হাতে পাওয়ার যে আনন্দময় অনুভূতি, তা তিনি অনুভব করতে পারেননি। পুরোনো বই মা-বাবা পড়ে শোনাতেন, তিনি শুনতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করলে চোখে দেখতে পান না বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাস্করসহ আরও কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল। এ ঘটনায় তাঁরা অনশন শুরু করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল। ভাস্কর সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফিল্ডওয়ার্ক করতে পারবেন না বলে ভর্তি নেয়নি কর্তৃপক্ষ। পরে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শেষ করেন।

পড়াশোনা নিয়ে আক্ষেপ থাকায় ভাস্কর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পড়াশোনার বিষয়টিতে নজর দিয়েছেন। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব বই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া (পুরো টেক্সট, পুরো অডিওসহ) বইয়ে রূপান্তরিত করেছেন। এ বইগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পড়তে পারছেন। সহজে ব্রেইলও করতে পারছেন।

ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের কেস স্টাডিতে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী মানুষের সহজ চলাচল (প্রবেশগম্যতা), তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে সফলতার সঙ্গে কাজ করা ব্যক্তির নাম ভাস্কর ভট্টাচার্য। কম্পিউটার এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করে ভাস্কর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন।

২০১৫ সালে লন্ডন বুক ফেয়ারে ভাস্কর।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের বাগদণ্ডী গ্রামে জন্ম ভাস্কর ভট্টাচার্যের। তাঁর জন্মের সময় গ্রামটিতে কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসক ছিলেন না। জন্মের পর নাক ও মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ভাস্করের বয়স দুই বছর হলে চোখে দেখতে না পাওয়ার বিষয়টি প্রথম বুঝতে পারেন তাঁর মা-বাবা। ব্যক্তিজীবনে ভাস্কর দুই মেয়ের জনক।

ভাস্করের নানা অর্জন

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১৮ সালে ডেইজি মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল বই প্রকাশের জন্য ভাস্কর ‘ডিজিটাল এমপাওয়ারমেন্ট অব পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস’ শীর্ষক ইউনেসকো পুরস্কার পান। অ্যাকসেসেবল ডিকশনারি তৈরির জন্যও পেয়েছেন সম্মাননা।

২০২১ সালে বিশ্বের ৩০ প্রভাবশালী প্রতিবন্ধী নেতার একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ‘ডি-৩০ ডিজঅ্যাবিলিটি লিস্ট-২০২১’ সম্মাননা পান তিনি। ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবন্ধীবিষয়ক আইনের (এডিএ) ৩১ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নেপাল, কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিবন্ধী নেতাদের সঙ্গে ভাস্কর এ সম্মাননা পেয়েছিলেন। ২০০২ সালে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে ১০ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল জাপানে ‘ডাসকিন লিডারশিপ ট্রেনিংয়ে’ এক বছরের এ প্রশিক্ষণের জন্য। সে তালিকায় ছিলেন ভাস্কর ভট্টাচার্য। ওই প্রশিক্ষণেই কম্পিউটারে ভাস্করের প্রথম হাতেখড়ি হয়। তারপর আর থেমে থাকেননি ভাস্কর ভট্টাচার্য। ‘জাপান ব্রেইল লাইব্রেরি’ এবং ‘মালয়েশিয়ান কাউন্সিল ফর দ্য ব্লাইন্ড’–এর সহায়তায় ভাস্করই চট্টগ্রামে প্রথম কম্পিউটারাইজড ব্রেইল প্রোডাকশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন।

ভাস্কর ভট্টাচার্য

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের প্রথম অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তৈরি করতে ভাস্কর দুই লাখের বেশি পৃষ্ঠার পাঠ্য উপকরণ অভিগম্য আকারে তৈরি করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারিতে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ এবং মাইগভের সেবা-সম্পর্কিত তথ্যগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহজবোধ্য করতে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। সরকারের প্রায় ৩৩ হাজার ওয়েবসাইট যাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ব্যবহার করতে পারেন, সে জন্য এটুআইয়ের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মারাক্কেশ চুক্তি অনুসমর্থন করেছে। এতে ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত যেকোনো বই দৃষ্টি ও পঠনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের এই চুক্তিতে অনুসমর্থনের বিষয়ে কাজ করেছেন ভাস্কর। ভাস্কর এ পর্যন্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বিনা মূল্যে পড়ার জন্য বাংলা স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার তৈরি করেছেন।

ভাস্কর তাঁর বিভিন্ন কাজের জন্য তুরস্কে অনুষ্ঠিত ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম থেকে ডব্লিউএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার, ন্যাশনাল ই-কনটেন্ট অ্যান্ড আইসিটিফরডি চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড, মন্থন পুরস্কার, আইএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার ২০১৬, হেনরি ভিসকার্ডি অ্যাওয়ার্ড ২০১৭সহ পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কয়েকবার প্যানেল আলোচক হিসেবেও অংশ নিয়েছেন ভাস্কর।

ভাস্কর ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতিবাচক কথা শুনে বড় হয় শিশুরা। পাঠ্যপুস্তকে এর আগে সফল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তুলে ধরার নজির নেই বললে চলে। পাঠ্যপুস্তকে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সফলভাবে তুলে ধরার যে নজির তৈরি হলো, তার ইতিবাচক ফল পাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং সমাজ।