• আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আবেদন করার হার গত শিক্ষাবর্ষের তুলনায় কমেছে ২৭ শতাংশ।
• ১৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে ক্ষতির আশঙ্কা।
• সরকার বলছে, মোট অভিবাসীর সংখ্যা ঠিক রাখা ও স্নাতক ভিসা তথা ‘গ্র্যাজুয়েট রুট’-এর অপব্যবহার ঠেকানোই উদ্দেশ্য।
যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদন হঠাৎ করে উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করেছে। এমন অবস্থায় ভিসা নীতিতে আরও বিধিনিষেধ আরোপে নানা আশঙ্কার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বলা হচ্ছে, বর্তমান অবস্থায় আরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে দেশটির বিলিয়ন ডলারের ‘সৃজনশীল ইন্ডাস্ট্রিতে’ মেধাবীদের সংকট তৈরি হতে পারে।
দ্য ব্রিটিশ একাডেমি সে দেশের মাইগ্রেশন অ্যাডভাইজরি কমিটিকে (এমএসি) জানিয়েছে, গ্র্যাজুয়েট ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যুক্তরাজ্যের একাডেমিক ও গবেষণার প্রাণবন্ত পরিবেশ নষ্ট করে দিতে পারে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমাগত কমিয়ে ফেললে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিভিন্ন কোর্স বন্ধ করে দেওয়া ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে হতে পারে।
চলতি বছরের শুরুতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত কিছু বিধিনিষেধের ফলে ইতিমধ্যে নতুন শিক্ষার্থীদের আবেদন কমে গেছে। এর ওপর যদি গ্র্যাজুয়েট ভিসার ওপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তবে তা আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। সম্প্রতি এক জরিপের তথ্য এমন আশঙ্কার কথাই বলা হয়েছে। ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটিস ইন্টারন্যাশনাল লিয়াইসন অ্যাসোসিয়েশনের ৭৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির আবেদন আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ কমে গেছে।
যুক্তরাজ্যে এখন একজন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনার সময় সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা খণ্ডকালীন কাজ বা চাকরি করতে পারেন। আর বন্ধের দিনগুলোতে যা করা যায় পূর্ণকালীন। পাশাপাশি একজন বিদেশি শিক্ষার্থী সেখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, মাস্টার্স কিংবা এমবিএ করার পর সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য যুক্তরাজ্যে বসবাস করার জন্য ভিসা পেতে পারেন।
এই দুই বছরের মধ্যে তাঁরা চাইলে যেকোনো কোম্পানিতে কাজ কিংবা চাকরি করতে পারবেন। এই ভিসাকে বলা হয় ‘গ্র্যাজুয়েট রুট’ ভিসা। আর পিএইচডি গ্র্যাজুয়েটরা এই ভিসা পান তিন বছরের জন্য। এর বাইরেও ‘স্কিলড ওয়ার্কার’ ভিসার মাধ্যমেও বিদেশি শিক্ষার্থীরা সেখানে বৈধভাবে কাজ করতে পারেন। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানে এই গ্র্যাজুয়েট ভিসার ওপর বিধিনিষেধ আরোপে আশঙ্কার কথা জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল।
যুক্তরাজ্যের ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রির আকার প্রায় ১৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ কোটি টাকা। যার একটি বিরাট অংশে জড়িয়ে আছে বিদেশি ট্যালেন্টদের অবদান। এসব বিদেশি ট্যালেন্টের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সেখানে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থী ও গবেষক। ভিসা নীতিতে বিধিনিষেধ আরোপের আশঙ্কার মাধ্যমে ট্যালেন্টদের বিরাট এই অংশ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিকে প্রতিনিধিত্ব করে ক্রিয়েটিভ ইউকে নামের একটি অলাভজনক সংস্থা। অন্যদিকে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারল্যান্ড মিলিয়ে মোট ১৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন ইউনিভার্সিটিস ইউকে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই দুই সংস্থা মিলে এক যৌথ চিঠিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে বলেছে, গ্র্যাজুয়েট ভিসায় কাটছাঁট কিংবা বিধিনিষেধ আরোপের যেকোনো পরিকল্পনা বাতিল করতে। কেননা, তাতে ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষতির আশঙ্কা আছে। তারা জানিয়েছে, এই ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি যুক্তরাজ্যের অ্যারোস্পেস, লাইফ সায়েন্স ও অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রির মিলিত আকার থেকেও বড়।
সেন্ট অ্যানড্রুস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ইউনিভার্সিটিস ইউকের প্রেসিডেন্ট স্যালি ম্যাপস্টোন স্কাই নিউজকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাজ্যের সংস্কৃতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবদান রাখেন, অর্থনীতিতে অবদান রাখেন, দক্ষতা খাত এবং চাকরির বাজারেও বিরাট অবদান রাখেন। সরকার যদি বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করে, তবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নয়, পুরো যুক্তরাজ্যের জন্যই তা হবে বিপর্যয়কর পদক্ষেপ।
চলতি বছরের মার্চ থেকেই স্নাতক ভিসার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে, যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি মাইগ্রেশন অ্যাডভাইজরি কমিটিকে নির্দেশ দেন, যাতে গ্র্যাজুয়েট রুট তথা স্নাতক ভিসার অপব্যবহার না হয়, তা নিশ্চিত করতে। বিশেষ করে স্টাডি ভিসা যাতে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে না হয়, তা খতিয়ে দেখতে।
কয়েক সপ্তাহ আগে সাবেক অভিবাসনমন্ত্রী রবার্ট জেনরিক সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ থিঙ্কট্যাংকের কাছে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যেখানে স্নাতক ভিসা বাতিল করার আহ্বান জানানো হয়। যেখানে দাবি করা হয়েছে, এই ভিসা বিদেশিদের গিগ ইকোনমিতে এবং খুব কম মজুরিতে কাজ করতে আসার সুযোগ দিচ্ছে।
একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের কাছে যুক্তরাজ্যে বিদেশিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। তবে আমরা মোট অভিবাসী মানুষের সংখ্যা ঠিক রাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার মধ্যে একটি ভারসাম্য রাখার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছি।’
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও ইউকে কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স