বাঁচতে হলে জানতে হবে
প্রিয় এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থী, শুভেচ্ছা রইল। এই সময়ে ডেঙ্গু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তোমাদের জন্য গুরুত্বটা আরও বেড়ে যায়। কারণ, তোমরা প্রত্যেকেই একটি পরিবারের স্বপ্ন, একটি স্কুলের আশা, একটি সমাজের ভবিষ্যৎকে সামনে নিয়ে পরীক্ষায় বসছ। তাই বিষয়টি মোটেই ভালো হবে না, যদি সামান্য সচেতনতার অভাবে সেই স্বপ্ন, আশা, ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। একটু সময় লাগলেও বিষয়গুলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জানা দরকার, প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরি করা দরকার।
ডেঙ্গু (Dengue), যার আরেক নাম ‘হাড়ভাঙা জ্বর’ (Break-bone Fever)। এই নাম থেকেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ডেঙ্গু একপ্রকার ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ, যা এডিস মশা থেকে মানুষে ছড়ায়। ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষ, এমনকি শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও অনেক ভুল ধারণা আছে, যার ফলে প্রতিবছর আমরা অনেক মানুষকে হারাই এই রোগে।
চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট মাসে ডেঙ্গু একপ্রকার ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এখন রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য শহর এবং গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু বেড়ে গেছে। জুলাই মাসে আমরা ডেঙ্গুতে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছি এবং সারা দেশে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৮০ হাজার ৭৪ জন। গতবছরের তুলনায় এবার মৃত্যুর সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪ জন শিক্ষার্থী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবরও আমরা দেখেছি। তাই ডেঙ্গুকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
পরীক্ষার্থীদের যদি একবার ডেঙ্গু হয় তাহলে সঠিক চিকিৎসার ফলে হয়তো একসময় সুস্থ হয়ে যাবে, কিন্তু যে বোর্ড পরীক্ষাগুলো মিস হয়ে যাবে, সেগুলো তো ফেরত পাওয়া যাবে না।
তাই ডেঙ্গুবিষয়ক সতর্কতার যে বিষয়গুলো জানব:
❖ ডেঙ্গুবিষয়ক ৩টি ভুল ধারণা
❖ ডেঙ্গু কেন হয়?
❖ কীভাবে বুঝব ডেঙ্গু হয়েছে?
❖ লক্ষণ দেখার পর করণীয় কী?
❖ চিকিৎসা কী?
❖ এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সতর্কতা
১. এডিস মশা শুধু সকালে কামড়ায়
এটি একটি ভুল ধারণা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এডিস মশা (ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশা) দিনের বেলায় কামড়াতে পছন্দ করে, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে অন্যান্য সময়েও কামড়ায়; বিশেষ করে ভোরে এবং সন্ধ্যায়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সম্প্রতি এডিস মশা তার আচরণ পাল্টে দিনের পাশাপাশি রাতেও কামড়ায়, যেটা আগে দেখা যায়নি।
২. ডেঙ্গু মশা শুধু হাত আর পায়েই কামড়ায়
এটাও একটি ভুল ধারণা। ডেঙ্গু মশা বা এডিশ মশা ত্বকের যেকোনো অংশের সরাসরি সংস্পর্শে এলেই সেখানে কামড়াতে পারে।
৩. এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু নিশ্চিত
এটাও একটা ভুল ধারণা। সব এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে না। শুধু ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হবে। সমস্যা হলো ভাইরাসবাহী মশাগুলোকে চোখে দেখে অন্যদের থেকে আলাদা করার কোনো উপায় নেই।
যেমনটা আগেই বলেছি, ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হতে পারে। শুধু যেসব এডিস মশা ৭ থেকে ১০ দিনের ইনকিউবেশন (ডিম তা দিয়ে বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়া) পিরিয়ড পার করার ফলে তাদের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস রেপ্লিকেট (অনুলিপি তৈরির প্রক্রিয়া) করতে পারে, সেসব এডিস মশা মানুষকে কামড়ালে ডেঙ্গু হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশির ভাগ লোকের হালকা বা কোনো উপসর্গ থাকে না এবং এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। কদাচিৎ ডেঙ্গু মারাত্মক হতে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হলো ডেঙ্গু টেস্ট করানো। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল সহ বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু টেস্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। ১২০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে একেকটি টেস্ট করানো যায়। সাধারনত দুইটি টেস্ট করাতে হয় । ডেঙ্গু সংক্রমণের ৪ থেকে ১০ দিন পর এর উপসর্গ দেখা দেয়। অর্থাৎ যদি আপনার ডেঙ্গু হয়, তাহলে ৪ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত বুঝতেই পারবেন না আপনার ডেঙ্গু হয়েছে, কী সাংঘাতিক ব্যাপার।
ডেঙ্গুর তিনতি ধরণ রয়েছে, 'এ', 'বি' ও 'সি'। প্রথম দুটিকে সাধারণ ডেঙ্গুর আওতায় ফেলা যায়। আর 'সি' ধরণটি মারাত্মক ডেঙ্গু নির্দেশ করে।
ডেঙ্গুর সাধারণ অবস্থায় উপসর্গগুলো হলো:
উচ্চ জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস)
প্রচণ্ড মাথাব্যথা
চোখের পেছনে ব্যথা
পেশি এবং জয়েন্টে ব্যথা
বমি বমি ভাব
বমি
গ্রন্থী ফুলে যাওয়া
ফুসকুড়ি
যারা দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের মারাত্মক ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি।
মারাত্মক ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো প্রায়ই জ্বর চলে যাওয়ার পরে আসে, যেমন:
সাংঘাতিক পেটে ব্যথা
অবিরাম বমি
দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস
মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত
ক্লান্তি
অস্থিরতা
বমি বা মলের সঙ্গে রক্ত
প্রচণ্ড পিপাসা
ত্বক ফ্যাকাশে এবং ঠান্ডা হয়ে আসা
দুর্বল বোধ করা বা শরীর ছেড়ে দেওয়া
এই গুরুতর উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। যাঁদের ডেঙ্গু হয়েছে, তাঁরা ডেঙ্গুমুক্ত হওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্লান্ত বোধ করতে পারেন।
লক্ষণ দেখার সাথে সাথেই একদম দেরি না করে দ্রুত ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। ডেঙ্গুর একক কোনো চিকিৎসা নেই এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে ঘরে রেখেই ব্যথানাশক ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা হতে পারে। উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর ব্যথানাশক ওষুধ (যেমন প্যারাসিটামল) দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমনটাই জানিয়েছে।
তবে যেকোনো লক্ষণ দেখেই নিজে নিজে ডাক্তারি না করে যেকোনো ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শেই ব্যবহার করা উচিত। তাই লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করান।
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দীন বিশ্বাস বলেন, শিক্ষার্থীদের রাস্তার পাশে, ড্রেনের ধারে কিংবা টং দোকানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দেখা যায় এবং তখন মশা কামড়ালেও তাঁরা টের পায়না। এমন ছোট অসতর্কতায় বড় বিপদ ঘটতে পারে। তাই মশার উৎপাদন স্থলের কাছে কিংবা মশা আছে এমন কোথাও আবস্থান করা উচিত নয়।
আগেই যেমনটা বলা হয়েছে ডেঙ্গুর একক কোনো চিকিৎসা নেই, তবে লক্ষণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ঢাকার ইউনাইটেড হসপিটালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আফসানা বেগম বলেন, ডেঙ্গু হলে কী ধরনের চিকিৎসা নেবেন, বাসায় না হাসপাতালে থাকবেন—নির্ভর করে এর ধরন বা ক্যাটাগরির ওপর। ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধরন বা ক্যাটাগরি আছে—‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’।
‘এ’ ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী এই ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই যথেষ্ট।
‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে। কিছু লক্ষণ, যেমন পেটে ব্যথা, বমি, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, অন্তঃসত্ত্বা, জন্মগত সমস্যা, কিডনি বা লিভারের সমস্যা থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো।
‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। এতে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।
কথায় আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম (Prevention is better than cure)। এইচএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে তোমার এখন এত সময় কোথায় অন্য হাজারো দিকে মনোযোগ দেওয়ার। তার চেয়ে বরং কিছু সতর্কতা অবলম্বন করো এবং নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নাও।
সতর্কতা হিসেবে যা করতে পারো:
১. অ্যান্টিমসকিটো ক্রিম বা মশানিরোধক ক্রিম ব্যবহার করতে পারো। শরীরের যেসব অংশ খোলা থাকে এবং মশায় কামড়ানোর আশঙ্কা থাকে, সেসব অংশে এই ক্রিম লাগিয়ে রাখতে পারো। এগুলো ভালো কাজে দেয়, মশা ধারেকাছেও আসে না। বাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবে, একটা কিনলে আশা করা যায় পুরো এইচএসসি পরীক্ষার সময়টা চালিয়ে নিতে পারবে।
২. মশারি ব্যবহার করা। তোমার এলাকায় যদি মশা খুব বেশি হয়, তাহলে অ্যান্টিমসকিটো ক্রিমের পাশাপাশি মশারি ব্যবহার করতে পারো। মশারি টাঙিয়ে এর ভেতর বসে পড়াশোনা করতে পারো। পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় হাত–পায়ে এবং ঘাড়ে অ্যান্টিমসকিটো ক্রিম লাগিয়ে যেতে পারো।
৩. অ্যান্টিমসকিটো ভ্যাপোরাইজার। এটার জন্য বিদ্যুৎ–সংযোগ লাগে। এটা মশার কয়েলের মতো কাজ করে, কিন্তু কোনো ধোঁয়া উৎপন্ন করে না। তবে বাজারে যেগুলো পাওয়া যায়, সেখানে নকল পণ্য থাকতে পারে। তাই বিশ্বস্ত দোকান থেকেই ভালো মানের ভ্যাপোরাইজার কেনা উচিত। ব্র্যান্ডভেদে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে ভ্যাপোরাইজার (কার্ট্রিজসহ) পাওয়া যায়।
৪. ফুলহাতা জামা এবং ফুলপ্যান্ট পরা। ঘরে-বাইরে এখন যতটুকু সম্ভব শরীর ঢেকে রাখাই ভালো, যেনো মশা কামড়ানোর সুযোগ না থাকে। সম্প্রতি কলকাতায় শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলে ফুলপ্যান্ট-ফুলহাতা শার্ট পরে আসতে বলা হয়েছে। আমাদের দেশেও এমন নির্দেশনা আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমাদের উচিত নিজ থেকে সচেতন হওয়া, কারণ তোমার জীবনটা একান্তই তোমার নিজের। তোমার জীবন, স্বাস্থ্য, পড়াশোনা, ক্যারিয়ার নিয়ে তোমাকেই তো সবার আগে সচেতন হতে হবে।
৫. মশা আছে এমন কোথাও না থাকা। এ বিষয়ে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দীন বিশ্বাস বলেন, শিক্ষার্থীদের রাস্তার পাশে, ড্রেনের ধারে কিংবা টং দোকানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দেখা যায় এবং তখন মশা কামড়ালেও তাঁরা টের পায়না। এমন ছোট অসতর্কতায় বড় বিপদ ঘটতে পারে। তাই মশার উৎপাদন স্থলের কাছে কিংবা মশা আছে এমন কোথাও আবস্থান করা উচিত নয়।