ত্রিকোণমিতির ইতিহাস (পর্ব-২)

বছরজুড়ে গণিত অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি

Eratosthenes' measurement of the Earth
Encyclopædia Britannica, Inc.

গত পর্বে আমরা দেখিয়েছিলাম, কীভাবে আধুনিক sine ফাংশনকে ভারতীয়রা বৃত্তের জ্যার সাহায্যে সংজ্ঞায়িত করেছিল। এবার আমরা দেখব sine ফাংশনকে কীভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানে কাজে লাগানো যায়। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষরা ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে চাঁদ ও সূর্যের দূরত্বের অনুপাত হিসাব করেছিলেন।   

এর আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের খুব প্রাথমিক একটি ধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। পৃথিবী তার নিজ কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে আবর্তন করছে। এ ছাড়া পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চাঁদ আবর্তন করে। সৌরজগতের অন্যান্য জ্যোতিষ্কও সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে। তাই পৃথিবীর সাপেক্ষে সৌরজগতের যেকোনো জ্যোতিষ্ক এবং সূর্যের অবস্থানের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে এবং একটি নির্দিষ্ট পর্যায়কাল পরপর একই অবস্থানের পুনরাবৃত্তিও ঘটছে।

পৃথিবীর সঙ্গে যেকোনো জ্যোতিষ্কের সংযোজক রেখা এবং পৃথিবী ও সূর্যের সংযোজক সরলরেখা যখন পরস্পর লম্ব অবস্থানে থাকে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ঘটনাকে বলা হয় কোয়াড্রেচার (quadrature) বা পাদসংস্থান। চিত্র-১-এ পৃথিবী ও চাঁদের কোয়াড্রেচার দেখানো হলো।

ভারতীয় জ্যোতিষরা (জ্যোতির্বিদ) জানতেন, চান্দ্র মাসের প্রথম ও তৃতীয় চতুর্ভাগে অর্থাৎ চাঁদ যখন মোটামুটি অর্ধেকটা আলোকিত থাকে, তখন পৃথিবী চাঁদের সঙ্গে কোয়াড্রেচারে থাকে। চিত্র: ২-এ ঘটনাটি ছবির সাহায্যে দেখানো হয়েছে।

চাঁদের সঙ্গে কোয়াড্রেচারের সময় চাঁদ (M), সূর্য (S) ও পৃথিবী (E)-কে তিনটি শীষবিন্দু ধরে একটি সমকোণী ∆MES ত্রিভূজ কল্পনা করা হলো এবং EH হল পর্যবেক্ষকের দিগন্ত (নিচের চিত্রে দ্রষ্টব্য)। এ অবস্থায় পৃথিবীতে থাকা একজন পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে সূর্যের উন্নতিকোণ, θ = ∠SEH এবং ∠MSE সমান কারণ, তারা একান্তর কোণ। তাই sinθ হবে পৃথিবী থেকে চাঁদ (dmoon) এবং পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের (dsun) অনুপাত। নিচে পুরো হিসাবটি দেখানো হল।

প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিতে পৃথিবী থেকে চাঁদ ও সূর্যের দূরত্বের অনুপাত নির্ণয়:

∠SEH = ∠MSE = θ

∆MES এ, ME/SE = dmoon/dsun = sinθ

পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত, θ ≈ 1/7 রেডিয়ান

∴ sin(1/7) ≈ 1/400

বা, dmoon/dsun ≈ 1/400

বা, dmoon ≈ dsun/400  (প্রাচীন ভারতীয় হিসাব)

এই পদ্ধতিতে প্রাচীন ভারতীয়রা পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং সূর্যের দূরত্বের যে অনুপাত (1/400) পেয়েছিলেন, তার সঙ্গে আধুনিক হিসাবের গড়মিল মাত্র 1.5%। আধুনিক হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং সূর্যের দূরত্বের অনুপাত প্রায় (1/394), যা নিচে দেখানো হয়েছে।  

পৃথিবী থেকে চাঁদ ও সূর্যের দূরত্বের আধুনিক পরিমাপ :

আধুনিক হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব, dsun = 150 মিলিয়ন কিলোমিটার

পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব, dmoon = 381000 কি.মি. = 0.381 মিলিয়ন কিলোমিটার

∴ dmoon/dsun = 0.381/150 ≈ 1/394

বা, dmoon ≈ dsun/394  (আধুনিক পরিমাপ)

আধুনিক ও প্রাচীন হিসাবের মধ্যে পার্থক্য = 1.5% (প্রায়)

উল্লেখ্য, চাঁদ যখন মোটামুটি অর্ধেকটা দেখা যায়, তখন চাঁদ ও পৃথিবী পাদসংস্থানে থাকে। এই অনুমান সর্বপ্রথম করেছিলেন গ্রিক জ্যোতির্বিদ অ্যারিস্টাকার্স খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। তাঁর হিসাবমতে, পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের অনুপাত ছিল 1/18 থেকে 1/20। সঠিকভাবে জ্যামিতিটা বের করতে পারলেও অ্যারিস্টাকার্স ত্রিকোণমিতিক মান নির্ণয়ে ভুল করেছিলেন। সম্ভবত, গ্রিকরা দশমিকের ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিল না বিধায়, অ্যারিস্টাকার্স সাইন ফাংশনের মান নিখুঁতভাবে আসন্নায়ন করতে পারেননি। যেকোনো ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের মান দশমিকের বেশ কয়েক ঘর পর পর্যন্ত নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে পারার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে ভারতীয় গণিতবিদদের।