কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি এভারিস্ট গ্যালোয়ার ছবি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি এভারিস্ট গ্যালোয়ার ছবি

এক রাতের গণিতবিদ

পাসচু ভালো মানের শুটার ছিলেন, পিস্তলের ওপর ছিল মারাত্মক দক্ষতা। তো তিনি এই ভালোবাসার খবর জানার পর গ্যালোয়ার ওপর খুব খেপে গেলেন এবং তাঁকে সামনাসামনি ডুয়েলে আহ্বান জানালেন। নির্দিষ্ট একটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে গুলি ছুড়তে হবে।

গণিতপ্রেমী বন্ধুরা, আশা করি সবাই ভালো আছ। আজ আমরা এমন এক গণিতবিদকে নিয়ে কথা বলব, যাকে ‘এক রাতের গণিতবিদ’ বলে সম্বোধন করা হয়। হয়তো অনেকে তাঁকে চেনে বা অনেকে চেনে না। তো আজ আমরা খাতা–কলম নিয়ে না বসে এক খুদে গণিতবিদের জীবনকাহিনি জানব। হ্যাঁ, তাঁকে খুদে গণিতবিদ বলাই যায় (যদিও তিনি অনেক বড় কাজ করেছিলেন)। তিনি হলেন এভারিস্ট গ্যালোয়া, ইংরেজিতে Evariste Galois. তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ (সেই সঙ্গে আরও একটি তকমা দেওয়াই যায়। সেটা হলো সাহসী প্রেমিক। কেন সাহসী প্রেমিক বললাম, সেটা পরে বলছি)।

এভারিস্ট গ্যালোয়া

গ্যালোয়া ২৫ অক্টোবর, ১৮১১ সালে ফ্রান্সের একটি ছোট্ট গ্রাম বুর্গ লা রিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন ফ্রান্সে বিরাট রকম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। এর মধ্যেই তিনি ১২ বছর বয়সে প্রথম স্কুলে যান এবং ১৪-১৫ বছর বয়সে গণিতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।

তিনি গণিতকে খুবই ভালোবেসে ফেলেন, গণিত ছাড়া তাঁর আর কিছুই ভালো লাগত না। এর ফলস্বরূপ দেখা গেল, তিনি গণিত ছাড়া অন্য কিছু করছেন না, সারা দিন শুধু গণিত আর গণিত। স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে দেখা গেল, তিনি গণিত ছাড়া অন্য বিষয়গুলোয় খারাপ করছেন। বলা যায় গণিতকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলেন তিনি।

তো এমনভাবে চলতে থাকল। একপর্যায়ে দেখা গেল, তিনি তাঁর স্কুলের গণিত শিক্ষককেও ছাপিয়ে গেছেন। তাঁর স্কুলে গণিত শেখার মতো কিছু নেই। তাই তিনি নিজে নিজেই গণিতচর্চা শুরু করেন বিভিন্ন বই সংগ্রহ করে।

গ্যালোয়া যে পরিমাণ গণিত বুঝতেন, তাঁর শিক্ষকেরাও অত বুঝতেন না। ফলে পরীক্ষার খাতায় তিনি যা লিখতেন, তা তাঁর শিক্ষকদের কাছে বোধগম্য হতো না। ফলে তাঁকে ঠিকঠাক নম্বরও দিতেন না তাঁরা। এভাবেই গণিত নিয়ে আনন্দে-দুঃখে তাঁর জীবন চলছিল। গ্যালোয়ার ত্রিঘাত, চতুর্ঘাত এবং পঞ্চঘাত সমীকরণ নিয়ে অনেক আগ্রহ ছিল।

তিনি অনেক খাটাখাটনি করে দুটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন। এগুলো তিনি একাডেমি অব সায়েন্সে জমা দেন। ওই গবেষণার বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ কসি (Cauchy)। তিনি গবেষণাপত্রগুলো দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি গ্যালোয়াকে অনেক উৎসাহ দেন। কিন্তু গবেষণাপত্রগুলো গ্যালোয়ার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমন নয় যে সেগুলো ভালো ছিল না বা অন্য কিছু, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। এ ঘটনায় তিনি ভীষণ দুঃখ পান এবং বুঝতে পারেন যে তাঁর কাজের সঠিক মূল্যায়ন হবে না।

এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর তাঁর জীবনে প্রেমের ছোঁয়া আসে। তিনি প্যারিসের এক নামকরা চিকিৎসকের মেয়ে স্টেফানি ফেলিসিকে ভালোবেসে ফেলেন। কীভাবে তাঁর মতো এক ভবঘুরে গণিতপাগলের সঙ্গে মেয়েটির ভালোবাসা গড়ে ওঠে, তা কেউ বলতে পারেননি। কিন্তু সমস্যা হলো, মেয়েটির একজন বাগদত্তা ছিল। তাঁর নাম ছিল পাসচু।

পাসচু ভালো মানের শুটার ছিলেন, পিস্তলের ওপর ছিল মারাত্মক দক্ষতা। তো তিনি এই ভালোবাসার খবর জানার পর গ্যালোয়ার ওপর খুব খেপে গেলেন এবং তাঁকে সামনাসামনি ডুয়েলে আহ্বান জানালেন। নির্দিষ্ট একটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে গুলি ছুড়তে হবে।

গ্যালোয়া তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। ডুয়েলের আগের রাতে তিনি বুঝতে পারলেন, এটাই হয়তো তাঁর জীবনের শেষ রাত। তাঁর গণিত নিয়ে অসাধারণ চিন্তাভাবনা আর আবিষ্কার কোথাও লিখে রাখা হয়নি। ফলে তিনি যদি পরদিন মারা যান, তাহলে পৃথিবীর কেউ এগুলো আর জানতে পারবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সেগুলো সব তিনি লিখে রাখবেন।

মাত্র একটি রাত সময় ছিল তাঁর কাছে। গ্যালোয়া রাত জেগে তাঁর থিওরেমগুলো লিখছেন, তাঁর হাতে বেশি সময় নেই। মাঝেমধ্যে মেয়েটির নাম লিখছেন, আবার নিজের কাজে ফিরে যাচ্ছেন। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, কেন এক রাতের গণিতবিদ বলেছি আমরা তাঁকে! লেখা শেষ হলে তিনি বন্ধুকে চিঠি লিখে বলেন, তিনি যদি পরদিন মারা যান, তাহলে তাঁর লেখাগুলো যেন ইউরোপের বড় বড় গণিতবিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় ব্যবস্থা করেন তিনি।

১৮৩২ সালের ৩১ মে। সেই ডুয়েলের দিন। দুই দিকে দুজন পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ডুয়েলের ফলাফল কী হতে পারে, তা হয়তো সবাই অনুমান করতে পারছ। হ্যাঁ, নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাঁকে। পরবর্তী সময়ে অনেকেই ধারণা করেন যে পাসচুর সঙ্গে স্টেফানির বাগদান ছিল সাজানো এবং পাসচু ছিলেন একজন পেশাদার খুনি। তো বুঝতেই পারছ, কেন তাঁকে একজন সাহসী প্রেমিকও বললাম। মূলত গ্যালোয়াকে হত্যা করার জন্যই (রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে) এ নাটক সাজানো হয়েছিল।

গ্যালোয়ার বন্ধু তাঁর কথামতো লেখাগুলো অনেক গণিতবিদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছোট্ট গ্যালোয়ার সেসব লেখার মর্মোদ্ধার করতে গিয়ে বড় বড় গণিতবিদের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত লেখাগুলো লিউভিল নামের এক গণিতবিদের কাছে পৌঁছায় এবং তিনি সেগুলো জার্নালে প্রকাশ করেন। মাত্র ২১ বছরের মতো বেঁচে ছিলেন গ্যালোয়া। এ অল্প সময়েই তিনি গণিতের প্রতি অসামান্য দক্ষতা ও খাঁটি ভালোবাসার অনন্য নজির রেখে গেছেন।