মনোযোগের অভাব, নিয়মিত ক্লাস না করা, লক্ষ্যের অভাব, আগ্রহের ঘাটতি, অভিভাবকদের উদাসীনতা, প্রতিকূল পরিবেশ, জিনগত কারণ এবং শিক্ষকের অযত্ন এই সবকিছু শিক্ষার্থীর ফলাফলে প্রভাব ফেলে।
একই শ্রেণিতে পড়ে, একই বই ও সিলেবাস অনুসরণ করে, একই শিক্ষকের কাছে পড়েও সব শিক্ষার্থী ভালো ফল করে না কেন? কেন একটি শ্রেণিতে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করে?
আমার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের মধ্যে কয়েকজন আছ, যারা ভালো ফল কর এবং মেধাবীও বটে, কিন্তু বেশি ভাগই ভালো ফল করছ না, যদিও তোমরা একই শ্রেণিতে পড়, তোমাদের বই ও সিলেবাস এক, সময় একই এবং একই শিক্ষকের কাছে পাঠ নিচ্ছ—এর কারণ কি তোমরা বলতে পারবে?
উত্তরে শিক্ষার্থীরা যা বলল,
স্যার পড়ালেখায় মনোযোগী না তাই।
নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে আসে না যে তাই।
লক্ষ্য নেই তাই।
পড়ালেখায় আগ্রহ নেই তাই।
গার্ডিয়ান সচেতন না যে তাই।
বুদ্ধাঙ্ক সূত্রের সাহায্যে একজন শিক্ষার্থীর স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড নির্ধারণ করা যেতে পারে। বুদ্ধাঙ্ক নির্ণয়ের সূত্রটি হলো—শিক্ষার্থীর মানসিক বয়স ÷ শিক্ষার্থীর আসল বয়স × ১০০
শিক্ষার্থীদের ভাসা ভাসা উত্তরের পাশাপাশি স্পষ্টত কিছু কারণ খুঁজে বের করব, যেসব কারণে সব শিক্ষার্থী ভালো ফল অর্জন করতে পারছে না।
তাবে তার আগে আসুন দেখা যাক মেধাবী শিক্ষার্থী বলতে আমরা কী বুঝি। বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘মেধা’ শব্দের অর্থ স্মরণশক্তি, স্মৃতিশক্তি, ধীশক্তি, বোধশক্তি; সহজ কথায় মুখস্থশক্তি। সংস্কৃত ‘ধীশক্তি’ শব্দের অর্থ বুদ্ধিশক্তি। বুদ্ধি শব্দের অর্থ বোধ, জ্ঞান, বিচারশক্তি প্রভৃতি। সবগুলো অর্থ বিশ্লেষণ করে একীভূত করা হলে মেধা শব্দের অর্থ হয়: স্মরণশক্তি, স্মৃতিশক্তি, মুখস্থশক্তি, বুদ্ধিশক্তি, বোধশক্তি, জ্ঞানশক্তি, বিচারশক্তি প্রভৃতি। অর্থাৎ যার স্মরণশক্তি ও বুদ্ধি আছে, তাদের মেধাবী বলা হয়।
মোদ্দাকথা যেসব শিক্ষার্থী বা শিক্ষার্থীদের স্মরণশক্তি, বোধশক্তি ও মুখস্থশক্তি ভালো; তাদের আমরা মেধাবী শিক্ষার্থী বলি। তবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, তারা খুব দ্রুত বোঝে; অর্থাৎ তাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্যাপাসিটি ভালো।
চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক সবাই ভালো ফল না করার কারণগুলো কী কী।। কারণগুলো দুই ভাগে ভাগ করে ব্যাখ্যা করছি— প্রথমটি আরোপিত কারণ এবং দ্বিতীয়টি দৈবিক কারণ।
আরোপিত কারণ হলো সেসব কারণ, যা শিক্ষার্থীর নিজের তৈরি করা এবং শিক্ষার্থী ইচ্ছে করলে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ধরনের কিছু কারণ নিচে ব্যাখ্যা করা হলো—
অতীতের কোনো নেতিবাচক ঘটনা আমাদের বর্তমানকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন অতীতে কেউ শেয়ার মার্কেটে অর্থ বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরবর্তী সময়ে আর শেয়ার মার্কেটে অর্থ বিনিয়োগ করতে চাইবে না। তদ্রূপ কোনো শিক্ষার্থী গণিত, ইংরেজি বা বিজ্ঞান বিষয়ে ফেল করলে পরবর্তী সময়ে ওই বিষয়টি নিয়ে সে হীনম্মন্যতায় ভোগে অথবা কোনো বিষয় কঠিন লাগলে শিক্ষার্থী ওই বিষয়কে ভয় পায় এবং পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে না। তাই অতীতের কোনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতা তার বর্তমানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর উচিত ওই বিষয়ের জটিলতা খুঁজে বের করে মৌলিক দিকগুলো বুঝতে চেষ্টা করা, এবং কার্যকর সমাধান বের করা।
আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী মেধাবী হয় না। একজন শিক্ষার্থী যখন মনে করে তার দ্বারা ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব নয়, তখন তার নিজের প্রতি নিজে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং সে বিশ্বাস করে নেয় যে আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
শিক্ষার্থীর বিশ্বাস সার্কাসের হাতির মতো হয়ে যায়। একটা হাতির বাচ্চাকে সামান্য একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় এবং সেই শিকলের বেড়ে হাতির বাচ্চাটি ঘুরতে থাকে, যখন হাতির বাচ্চাটি গণ্ডি পেরোতেচায়, তখন শিকলটির পায়ে টান লাগে। আর এতেই হাতির বাচ্চাটি বিশ্বাস করে নেয় যে সে আর কোনো দিন এই শিকল ছিঁড়তে পারবে না। এভাবেই সে বড় হয়। অথচ হাতি জানে না যে এ শিকলের চেয়ে সে কতটা শক্তিশালী। তাই একজন শিক্ষার্থীকে আগে বিশ্বাস করতে হবে যে সে মেধাবী হতে পারবে, ভালো ফল করতে পারবে এবং তার মধ্যে সেই শক্তি বিদ্যমান রয়েছে। তাহলে শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মাবে।
দূরদর্শিতার অভাবে অনেক শিক্ষার্থী পেছনে পড়ে যায়। তার ভবিষ্যৎ জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় সে দূরদর্শী হতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী ভালো ফল করতে পারলে ভবিষ্যতে সে কী কী সুবিধা ভোগ করতে পারবে তা আগে থেকে জেনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের একই প্রতিষ্ঠানের বড়ভাই কিংবা বড়বোন কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। তবে খেয়াল রাখা জরুরি সেই বড়ভাই কিংবা বড়বোন কেমন। এমন কারো কাছ থেকেই পরামর্শ নেওয়া উচিত যা শিক্ষার্থীর দূরদর্শিতা বাড়াতে সাহায্য করবে। তা ছাড়া শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদেরও সাহায্য নিতে পারে। শিক্ষকদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যৎ ও ক্যারিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করত পারে। দূরদর্শিতা বাড়াতে শিক্ষার্থীকে নিজের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বইপত্র এবং পত্রপত্রিকা পড়তে হবে।
পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ একজন শিক্ষার্থীকে মেধাবী করে তোলে। এ আগ্রহের অভাবে একজন শিক্ষার্থী মেধাবী হয় না। যেকোনো কাজ আগ্রহ নিয়ে মন থেকে করলে ওই কাজে অবশ্যই ভালো করা সম্ভব। আগ্রহ নিজে নিজে তৈরি হয়না, কোনো কাজের প্রতি ভালো লাগা থেকেই সেই কাজে প্রবল আগ্রহ জন্মায়। আর কাজের প্রতি ভালো লাগা জন্মায় কাজের স্বীকৃতি পেলে বা সেই কাজের যথাযথ মর্যাদা পেলে। তাই পড়াশোনার আগ্রহ ভালো লাগা থেকে আসা উচিত। প্রবল আগ্রহের কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়েছেন। তাই শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন আগ্রহ নিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করা।
দৈবিক কারণ হলো সেসব কারণ, যা তৃতীয় কোনো পক্ষ দ্বারা বা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়। যার নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার্থীর নাগালের বাইরে। তবে শিক্ষার্থী চাইলেই এর মাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে পারে। অনেকটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো। আমরা চাইলেই ঘূর্ণিঝড় বন্ধ করতে পারব না, তবে এর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে পারব।
এ ধরনের কিছু কারণ নিচে ব্যাখ্যা করা হলো—
প্রতিকূল পরিবেশ বলতে শিক্ষার্থীদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেমন আর্থিক সংকট, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের অভাব, পারিবারিক কলহ, পড়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা, খারাপ বন্ধুবান্ধব ইত্যাদি। এ ধরনের বিভিন্ন প্রতিকূলতা একজন শিক্ষার্থীকে মেধাবী হতে বাধাগ্রস্ত করে। তাই পরিবারের উচিত সন্তানের মেধা বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
অভিভাবক যদি সচেতন না হয়, তাহলে অনেক মেধা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। অভিভাবকের সঠিক তদারকি বা পরিচর্যা একজন শিক্ষার্থীকে মেধাবী করে তুলতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাকে যদি একটি পর্বত আরোহণের মতো করে ভাবা হয়, তাহলে শিক্ষক সেই পর্বতের চূড়ায় অবস্থান করে। আর শিক্ষার্থীরা পর্বত আরোহণে সচেষ্ট থাকে। যেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে টেনে ওঠানোর চেষ্টা করেন। একই সাথে অভিভাবকদের শিক্ষার্থীদের পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ওপরে দিকে যেতে দিতে হয়। অভিভাবকের উচিত শিক্ষার্থীর পড়াশোনা নিয়ে প্রতিদিন খোঁজখবর নেওয়া, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, খেলাধুলা, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি যে জিনগত কারণে বা বংশগত বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক শিক্ষার্থী মেধাবী হয়। যদি মা–বাবা মেধাবী হয়, তাহলে সন্তানও মেধাবী হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে মা–বাবা মেধাবী, কিন্তু সন্তান মেধাবী নয়। অনুরূপভাবে আমরা দেখি যে মা–বাবা মেধাবী নয়, কিন্তু সন্তান মেধাবী। তাই জিনগত বিষয় যদিও সন্তান মেধাবী হতে সাহায্য করে; তবে সব সময় শতভাগ কর্যকর নয়।
আমাদের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন শ্রেণির পরীক্ষায় ফেল করলেও পরবর্তী ক্লাসে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে করে প্রতিটি শ্রেণির স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড মানা হচ্ছে না। আবার একজন শিক্ষার্থী তার বয়স ও মানসিক বুদ্ধি অনুপাতে যে শ্রেণিতে পড়ার কথা, সেই শ্রেণিতে না পড়ে যদি ওপরের শ্রেণিতে পড়ে, তখন সে পড়াশোনাকে চাপ হিসেবে দেখে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি উপযোগী স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড নির্ধারণ করা উচিত।
শিক্ষার্থীর মানসিক বয়স বের করার জন্য বিভিন্ন সাধারণ জ্ঞানমূলক প্রশ্ন বা আইকিউ টাইপের প্রশ্ন করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের অযত্ন–অবহেলা মেধাবী শিক্ষার্থী না হওয়ার অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ যেমন শুধু ভালো শিক্ষার্থীদের পক্ষপাতিত্ব করা, ভালো শিক্ষার্থীদের প্রতি ফোকাস রাখা, দুর্বল শিক্ষার্থীদের সুযোগ না দেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের বিভিন্ন কারণ শিক্ষার্থী মেধাবী না হওয়ার জন্য দায়ী। আমরা হয়তো অনেকেই জানি যে; মাঝারি মানের শিক্ষক ‘বলেন’, ভালো শিক্ষক ‘বুঝিয়ে দেন’, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ‘করে দেখান’ এবং মহান শিক্ষক ‘অনুপ্রাণিত করেন’। তাই শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সঞ্চালক হিসেবে কাজ করতে হবে। কারণ, শিক্ষক হলেন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার উৎস। শিক্ষক চাইলেই একজন শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন, শিক্ষার্থীদের মেধা ও চিন্তাশক্তি জাগ্রত করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকে রঙিন করতে পারেন। তাই আমি মনে করি, মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরির পেছনে শিক্ষকদের ভূমিকা সর্বাগ্রে।
মেহেদী হাসান, প্রভাষক (উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন),
গণউদ্যোগ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা