নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম ‘বই বিতরণ উৎসব-২০২৪’
নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম ‘বই বিতরণ উৎসব-২০২৪’

নতুন বছর নতুন শিক্ষাক্রম নতুন বই: জীবনমুখী শিক্ষাপদ্ধতি

নতুন বই কীভাবে পড়ব

সুপ্তি এই বছর নবম শ্রেণিতে উঠেছে। প্রতিবছর সে যখন নতুন শ্রেণিতে প্রমোশন পায়, তখন নতুন বই হাতে পাওয়ার জন্য সে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে। বই হাতে পাওয়ার পর তার মধ্যে দেখা দেয় প্রবল উত্তজনা। বইগুলোর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সে বছরের শুরুতেই পড়ে ফেলে। কিন্তু এই বছরের বইগুলো পড়তে গিয়ে সুপ্তির খানিকটা খটকা লাগল। বইগুলো ঠিক আগের বছরের বইয়ের মতো নয়! ২০২৪ সালে সুপ্তির মতো অনেক শিক্ষার্থীর মনেই এ ধরনের প্রশ্ন জাগতে পারে।

আসলে এই বছর কিছু শ্রেণিতে নতুন আঙ্গিকে শিখন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যারা মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে, তারা একটি নতুন শিক্ষাক্রমের (জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২) আলোকে পড়াশোনা শুরু করতে যাচ্ছে। যদিও সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গত বছর এই নতুন শিক্ষাক্রমের অধীন শেষ করেছে। আগের তুলনায় নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয় ও পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। সে অনুযায়ী আমাদের পাঠ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। তোমাদের অনেকের জিজ্ঞাসা থাকতে পারে, নতুন ক্লাসে কী কী বিষয় পড়তে হবে? নতুন বইগুলোই–বা কীভাবে পড়তে হবে?

পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা বাস্তবজীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। তাই আমি এই শিক্ষাপদ্ধতিকে ‘জীবনমুখী শিক্ষাপদ্ধতি’ বলব। অর্থাৎ সৃজনশীল পদ্ধতির স্থলে জীবনমুখী পদ্ধতি চালু হয়েছে।

এই বছর যারা ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাশে পড়াশোনা শুরু করেছে, তাদের শিখনের জন্য ১০টি ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ১০ ক্ষেত্রে ১০টি বিষয় অনুশীলন করে পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। ১০টি ক্ষেত্রে বিষয়ের ধারণা আমরা নিচের ছক থেকে পেতে পারি—
শিখন-ক্ষেত্র

ভাষা ও যোগাযোগ

গণিত ও যুক্তি

জীবন ও জীবিকা

সমাজ ও বিশ্বনাগরিকত্ব

পরিবেশ ও জলবায়ু

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ডিজিটাল প্রযুক্তি

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা

ধর্ম, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা

শিল্প ও সংস্কৃতি

নির্বাচিত বিষয়

১. বাংলা

২. ইংরেজি

৩. গণিত

৪. বিজ্ঞান

৫. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান

৬. ডিজিটাল প্রযুক্তি

৭. জীবন ও জীবিকা

৮. স্বাস্থ্য সুরক্ষা

৯. ধর্মশিক্ষা

১০. শিল্প ও সংস্কৃতি

মানুষ মাত্রই শৈশব থেকে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকে। এই অভিজ্ঞতাগুলোকে শাণিত করার জন্য দরকার উপযুক্ত শিক্ষা। শিক্ষার অন্যতম উপকরণ বই। আগের পাঠ্যবইয়ে শুধু পাঠ আলোচনা থাকত। এবারের নতুন বইয়ে পাঠ আলোচনার পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা যোগ করা হয়েছে। নির্দেশনাগুলো পালন করে পাঠে অগ্রসর হতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে যাবে এবং আরেকটি অভিজ্ঞতা নিয়ে বের হবে।

শিক্ষকের সহায়তায় নতুন পাঠ্যবই শিক্ষার্থীকে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের দিকে নিয়ে যাবে। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত যোগ্যতাগুলোয় পারদর্শিতা অর্জন করবে। পারদর্শিতা অর্জনের দিকে লক্ষ রেখে নতুন পাঠ্যবইয়ের বর্ণনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমরা যদি পরিবর্তন বুঝতে পারি, তাহলে নতুন বই অনুশীলন করতে মোটেও অসুবিধা হবে না। 

এবারের পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন অধ্যায়ের অধীন যে পরিচ্ছেদগুলো আছে, সেগুলো অনুশীলনের সময় চারটি ধাপ অনুসরণ করে অগ্রসর হতে হবে। ধাপগুলো হচ্ছে—

১. প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা

প্রথম ধাপে দৈনন্দিন জীবনের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ঘটনার প্রকাশ থাকবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নিজের অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতা বা চারপাশের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করতে পারবে। ফলে শিখনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর দূরত্ব তৈরি হবে না এবং শিখনকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে তারা উৎসাহিত হবে।

২. প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ

পূর্ব অভিজ্ঞতাকে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিফলন করে শিখনের যে ধাপের সূচনা হয়, তা হলো প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ। এ ধাপে কিছু সময়ের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার বিষয়টি নিয়ে ভাবার পরিবেশ ও পথ সৃষ্টি করে দেওয়া হবে। এতে শিক্ষার্থী তার অভিজ্ঞতা পরখ করতে পারবে, অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারবে এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়ে আগ্রহী হবে।

৩. বিমূর্ত ধারণায়ন

এটি শিখনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ ধাপে প্রয়োজনীয় তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে এবং সহায়ক উপকরণের সাহায্যে বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়া থাকবে। এতে শিক্ষার্থী পঠিত বিষয় সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারবে।

৪. সক্রিয় পরীক্ষণ

সবশেষ ধাপে উপযুক্ত কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শিখনকে বাস্তবে প্রয়োগ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে। এ জন্য কিছু বাস্তব সমস্যা বা অবস্থার কথা উল্লেখ থাকবে। শিক্ষার্থী আগের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান প্রয়োগ করে এ ক্ষেত্রে তার পারদর্শিতার প্রমাণ দেখাবে। 

পরিশেষে বলা যায়, এই চার ধাপ অনুসরণ করে যদি নতুন পাঠ্যবইয়ে অগ্রসর হওয়া যায়, তাহলে পাঠ্যবই নিয়ে আমাদের দ্বিধা কমে আসবে। তাই নতুনভাবে শুরু হোক নতুন বইয়ের অনুশীলন। 

জাহেদ হোসেন, মাস্টার ট্রেইনার, শিক্ষক, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা