প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক

সমন্বয়হীনতায় ঠিক পথে নেই নতুন শিক্ষাক্রম

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে হোঁচট। প্রাথমিকে জানুয়ারিতে শুরু হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রম সমন্বিতভাবে হওয়ার কথা থাকলেও এ নিয়ে কার্যত দুই পথে হাঁটছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন। তিন মাসের বেশি সময় আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সমন্বিত জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার অনুমোদন দিলেও দুই প্রশাসনের সমন্বয়হীনতায় কাজটি ঠিকভাবে এগোচ্ছে না। ১৬ দিন পর শুরু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের প্রথম ও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এখনো বই লেখা এবং শিক্ষাক্রমের চূড়ান্ত অনুমোদনের কাজ শেষ হয়নি।

উপরন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই কীভাবে হচ্ছে, তা নিয়ে একে অপরের তথ্য জানে না এনসিটিবির মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শাখা। এর মধ্যেই মাধ্যমিক প্রশাসন আলাদাভাবেই প্রশিক্ষণ, বই লেখাসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু করেছে। আর প্রাথমিকের বই লেখার কাজই শুরু হয়নি। প্রাথমিক প্রশাসন চায় তাদের করা শিক্ষাক্রমের ছক ধরে কাজটি করতে। এ অবস্থায় নতুন এই শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ধারাবাহিকতা রক্ষা নিয়ে যেমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তেমনি মাধ্যমিকের সঙ্গে প্রাথমিক স্তরেও জানুয়ারির শুরুতে এর বাস্তবায়ন পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হবে কি না, তা-ও অনিশ্চিত।

উৎসবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নতুন বই তুলে ধরে আনন্দ প্রকাশ করছে

এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, মূলত প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের অনীহার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এত দিন পর বাস্তবায়নের আগ মুহূর্তে এসে প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত অনুমোদন পাওয়া জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার কপিসহ বিভিন্ন তথ্য চাইছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগ পর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা রাখা হয়নি। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান প্রশাসন একটি বোর্ড গঠন করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাকে স্থায়ী করার উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে তারা প্রাথমিকের শিক্ষাক্রমের জন্য আলাদা এনসিটিবি করারও চিন্তাভাবনা করছে। এ জন্যই হয়তো নতুন শিক্ষাক্রম যাতে বাস্তবায়ন না হয়, সে জন্য কৌশলে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।

কাজ করতে গিয়ে বারবারই মনে হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে একসঙ্গে কাজটি করলে অনেক বিভ্রান্তি দূর হতো ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সহজ হতো।
অধ্যাপক এম তারিক আহসান, সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি

অবশ্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান নারায়ন চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারিতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের দুই শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হবে। এ বিষয়ে সেভাবেই কার্যক্রম চলছে।

মূল্যায়ন এবং শিখন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন এনে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী বছর থেকে প্রথম শ্রেণি ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার কথা। এরপর ২০২৩ সাল থেকে অন্যান্য শ্রেণিতে পর্যায়ক্রমে চালু হবে।

এনসিটিবি শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজটি করছে। এনসিটিবিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ সেপ্টেম্বর নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বিষয়ে সম্মতি দিলেও এখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির যৌথ সভায় শিক্ষাক্রমের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এমনকি রূপরেখাটিও চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়নি।

সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় তিন ধাপে বই

বই প্রণয়ন নিয়েও দুই মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মাধ্যমিক প্রশাসন আলাদাভাবেই মাধ্যমিকের বই প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। তবে হাতে সময় কম থাকায় ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের পুরো বিষয়বস্তু একসঙ্গে না দিয়ে বছরে তিন ধাপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা।

অর্থাৎ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রথমে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত উপযোগী বইয়ের বিষয়বস্তু দেওয়া হবে। এরপর মে থেকে আগস্টের এবং সবশেষে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বইয়ের বিষয়বস্তু দেওয়া হবে। অর্থাৎ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলেও একজন শিক্ষার্থী একসঙ্গে পুরো বই পাচ্ছে না।

অন্যদিকে এনসিটিবির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এখনো প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির বই লেখার কাজ ও প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়নি। ফলে নতুন বছরের শুরুতে প্রাথমিকে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাক্রমের রূপরেখার সঙ্গে সংগতি রেখেই তাঁরা কাজ করছেন। সমন্বয়ও আছে। তবে যেহেতু তাঁদের প্রস্তুতি একটু পিছিয়ে গেছে, তাই জানুয়ারির শেষ দিকে বা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে শুরু করতে পারবেন। তাঁরা যে সময়সীমা ধরে এগোচ্ছেন, তাতে ২৬ ডিসেম্বর থেকে বই লেখার কাজ শুরু করবেন।

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক এম তারিক আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর জানুয়ারি থেকে মাধ্যমিকে পরীক্ষামূলক চালুর জন্য বিষয় ও উপকরণ উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণের কাজ চলছে পুরোদমে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে বারবারই মনে হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে একসঙ্গে কাজটি করলে অনেক বিভ্রান্তি দূর হতো ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সহজ হতো।