বছরজুড়ে গণিত অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি
গত পর্বে শূন্যের ইতিহাস জেনেছি কিছুটা। এটুকুতেই ইতিহাস শেষ যারা মনে করেছ, তাদের জন্য মজার খবর হলো, ভারতীয় গণিতের ইতিহাস অতি প্রাচীন। গণনা থেকে যে গণিতের উৎপত্তি, সেই গণনা কে কবে শুরু করেছিল, তার ইতিহাস আমাদের জানা নেই। এমনকি শূন্য আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মূল অবদান কার, সেটাও জানা যায়নি। বেশি বড় আর বিস্তৃত হলে যেটা হয় আরকি! তবে এটা যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক আবিষ্কার, তা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই।
শূন্য আবিষ্কার না হলে মানবসভ্যতার দ্রুত অগ্রগতি সম্ভব হতো কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। গণিতে ‘শূন্য’ আবিষ্কার যে ভারতবর্ষে হয়েছিল, এ ব্যাপারেও আজ আর দ্বিমত নেই। প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে, মিসরে, ব্যাবিলনে ও চীনে দশ ধরে গণনা করার পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তবে যেসব সংকেতের সাহায্যে মিসরীয়রা, ব্যাবিলনীয়রা বা গ্রিকরা—সংখ্যা প্রকাশের চেষ্টা করত, তাতে শূন্যের কোনো ধারণা ছিল না।
এসব সংকেতের সাহায্যে ক্ষুদ্র সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা না হলেও বৃহৎ সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে খুবই অসুবিধা হতো। শূন্য ধরে মাত্র ১০টি সংকেতের সাহায্যে সনাতন পণ্ডিতদের আবিষ্কৃত অঙ্কপাতন পদ্ধতি এক নতুন যুগের সূচনা করে। এই নিয়ম আবিষ্কৃত হওয়ার ফলেই সংখ্যার ঘরগুলো একক, দশক, শতক, সহস্র ইত্যাদিতে 10 গুণ করে প্রকাশ করা হয়।
আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ বিজ্ঞানীর রচিত গাণিতিক ও জ্যোতিষীয় রচনার এই পদ্ধতির বহুল ব্যবহার দেখা যায়। তাই অনুমান করা যায়, আর্যভট্টের (আনুমানিক 499 খ্রিষ্টাব্দ) সময়কালের বহু আগে থেকেই এ দেশে এই পদ্ধতির প্রচলন ছিল।
তোমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারো যে শূন্য আবিষ্কৃত না হলে দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতির উদ্ভব সম্ভব হতো না। এ ছাড়া একক, দশক, শতক ইত্যাদি ভাগে 1002 সংখ্যাটি লিখতে হলে দশক এবং শতকের ঘরে মানহীন বা শূন্যস্থান বোঝাতে কোনো প্রতীকের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয়। তাই হয়তো আর্যভট্টের সময়কালের বহু আগেই সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শূন্যকে সংখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
‘ছন্দসূত্র’–এ (রচনাকাল: আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ েথকে ২০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে রচনা করেন “ছন্দসূত্র” যেখানে তিনি শূন্যের উল্লেখ করেন বলে জানা যায়। আর্যভট্ট কর্তৃক বর্গমূল নির্ণয় পদ্ধতি দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন ও শূন্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ গ্রন্থে বরাহমিহির (আনুমানিক খ্রিষ্টাব্দ 505) বারবার শূন্যের উল্লেখ করেছেন।
বরাহমিহিরের সমসাময়িক জিনভদ্রতানির রচনায় শূন্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তিনি তাঁর রচনায় বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যা লেখার সময় একাধিক শূন্যের ব্যবহার করেন। বর্তমানে শূন্যের যে প্রতীক ব্যবহৃত হয়, প্রথম দিকে তা ছিল না।
সে সময় এর প্রতীক ছিল একটি বিন্দু (•)। শূন্যের প্রতীক কবে বিন্দু থেকে ছোট বৃত্তের আকারে উন্নীত হয়, তা অনুমানের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। টলেমি তাঁর ‘অ্যালমাজেস্ট’ গ্রন্থে শূন্যস্থানের জন্য গ্রিক বর্ণ Omicron (০) ব্যবহার করেন।
সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে 1, 2, 3, 4 অঙ্কের সংখ্যাপদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্যের গণিতবিদ আল–খোয়ারিজমি এবং আল–কিন্দির হাত ধরে ইউরোপে প্রবেশ করে। ইউরোপে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে দশ অঙ্ক নিয়ে গণনা শুরু হয়। বিশ্বের মান্য গণিতজ্ঞরা সে জন্য এগুলোকে ‘Hindu-Arabic Numerals’ বলেছেন।
আল–বিরুনি ভারত ভ্রমণের সময় একেকটি প্রদেশে 1 থেকে 9 এর জন্য প্ৰদেশভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যাচিহ্ন ও 0–এর লিপির কথা বলেছেন। কিন্তু শুধু আমাদের বাংলাতেই ‘০’ কিংবা ইংরেজিতে ‘0’ আছে? মোটেই নয়। নানা দেশে নানা ভাষায় শূন্য দেখে নেই চলো:
একেকটা শূন্য দেখতে একেক রকম, এদের নামগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। 1598 সালে প্রথম ইংরেজিতে Zero শব্দটি প্রয়োগ করা হয়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এই Zero শব্দটি এসেছে ভেনিশীয় শব্দ Zero থেকে, যা আবার ইতালীয় Zefiro পরিবর্তিত হয়ে এসেছিল। ইতালীয় Zefiro শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘সাফাইর’ বা ‘সাফাইরা’ (صفر) থেকে, যার অর্থ সেখানে কিছু ছিল না।
এই শব্দটি প্রথমে ভারতীয় সংস্কৃত শুন্যেয়া শব্দ হতে অনূদিত হয়েছে। সংস্কৃত শব্দ শুন্যেয়া (শূন্য) যার অর্থ খালি বা ফাঁকা। গণিতে ‘শূন্য’ আবিষ্কার ভারতবর্ষে হয়েছিল এবং ভারতবর্ষের সংস্কৃত শব্দ শুন্যেয়া (শূন্য) আরবের ‘সিফর’ হয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমে Zero–তে পরিণত হলো।