বছরজুড়ে গণিত অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি
গত তিন পর্বে আমরা হটেনটট, কামিলারই থেকে আমাদের যাত্রা শুরু করে মিসরে ঢুঁ দিয়ে ব্যাবিলন, গ্রিক ও রোমান হয়ে মায়ান পার করে আধুনিক সংখ্যাপদ্ধতিতে চলে এসেছি। আজকের পর্ব থেকে আমাদের আলোচনা শুরু হবে আধুনিক সংখ্যাপদ্ধতি এবং এর বিভিন্ন শাখা–প্রশাখা নিয়ে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার করি, সেটা মূলত ১০ ভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। একে বলে ডেসিমেল(010)! আচ্ছা তোমাদের কী মনে হয়? ১০ ভিত্তিকই হয় শুধু? উত্তর হলো, না। প্রচলিত কিছু পদ্ধতি হলো—বাইনারি (02); টাইনারি (03); কোয়াটারনারি (04); কুইনারি (05); সেনারি (06); অকট্যাল (08); ডুওডেসিমেল (012); হেক্সাডেসিমেল (016); ভাইজেসিমেল (020)ইত্যাদি।
আজকের পর্বে আমরা মূলত ডেসিমেল নিয়ে কথা বলব। একই সঙ্গে কিছু সংজ্ঞা, আর ওই যে আরও কিছু সংখ্যাপদ্ধতির কথা বললাম না, সেটারই একটু ধারণা দেব। গণিতকে ছোটবেলায় আমরা অঙ্ক বলতাম, মনে আছে? অঙ্ক খাতা, অঙ্ক বই বলতাম! আসলে অঙ্ক হলো গণিতের খুব ছোট্ট একটা অংশ! অঙ্ক (Digit) হলো মূলত সংখ্যা লেখার প্রতীকগুলো। অর্থাৎ আমাদের পরিচিত ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ এবং ৯ হলো অঙ্ক। ওদিকে সংখ্যা হলো অঙ্ক ব্যবহার করে তৈরি কিছু মাননির্দেশক প্রতীক। এখন বলো তো ১৮–কে তুমি কী বলবে? অবশ্যই সংখ্যা! আর ৭–কে? এটা তো সংখ্যাও আবার অঙ্কও! তবে একটা সম্পর্ক যদি চিন্তা করি সংখ্যা আর অঙ্কের মধ্যে, তাহলে ব্যাপারটা হবে এমন যে ‘সব অঙ্কই সংখ্যা, কিন্তু সব সংখ্যা অঙ্ক নয়!’
এবার বুঝতে পেরেছ তো? তুমি গণিতের কত্ত ছোট্ট একটা অংশের নাম দিয়ে এত দিন পুরো গণিতকে বুঝিয়ে এসেছ! কিন্তু এই প্রতীকগুলো আসলে এলো কোথা থেকে? কীভাবে? চলো জেনে আসি!
এককভাবে মানের অস্তিত্বহীনতা ও অন্যান্য অঙ্কের পরে বসে তাদের স্থানীয় মান বাড়িয়ে দেয়। নিজের কোনো মান নেই, কিন্তু অন্যের মান দশ গুণ করে বাড়িয়ে দেয় এই শূন্য! এ ছাড়া দশমিকের ডানে বসে এটি বিভিন্ন সংখ্যার মান আবার কমিয়ে দেয়, অর্থাৎ একটা করে বাড়তে থাকে আর মান ১০ ভাগের ১ ভাগ হতে থাকে। দেখেছ? গণিতের মধ্যে বাস্তবিক শিক্ষাও আছে বটে! যে তোমাকে পেছন থেকে সহায়তা করে ওপরে তুলে দিতে পারে, সে চাইলে একনিমেষে তোমাকে মাটিতে মিশিয়েও দিতে পারে কিন্তু!
শূন্যকে অনেকে ধনাত্মক হিসেবে মানতে চায় না, আবার অনেকে ঋণাত্মক হিসেবেও মানতে চায় না। তাই শুধু শূন্যের কারণে দুটি সংখ্যার সেট বাজারে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি হলো ধনাত্মক সংখ্যার সেট (০ বাদে ১ থেকে অসীম ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যার সেট); আরেকটি অঋণাত্মক (০ সহ ১ থেকে অসীম পর্যন্ত সব ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যার সেট)। এখন তোমার মনে প্রশ্ন আসবে যে অঋণাত্মক আর ধনাত্মকের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
পার্থক্য শুধু শুেন্য। কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম যে তুমি চাইলে ০ কে অঋণাত্মক না বলে অধনাত্মক বললেও খুব একটা অপরাধ হবে না। তাহলে শূন্য আসলে কী? এটা হলো নিরপেক্ষ সংখ্যা বা নিউট্রাল সংখ্যা, যেটা ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক কোনোটাই না। তবে ০ কে আবার সাহায্যকারী অঙ্কও বলা হয়েছে সংখ্যার মানকে নিমেষেই দশ গুণ করে দেওয়ার জন্য! আবার নিজের কোনো মান না থাকা সত্ত্বেও একমাত্র এই শূন্যই পারে যেকোনো সংখ্যাকে নিমেষে ধূলিসাৎ করে ফেলতে। যেকোনো সংখ্যাকে ০ দিয়ে গুণ বা ভাগ করলেই বুঝবে এর ক্ষমতা!
কিন্তু কে নিয়ে এল এই শূন্য? ভারতীয় উপমহাদেশের আর্যভট্ট (৪৭৫–৫৫০ খ্রি.) ‘০’ (শূন্য) সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন। এর ঠিক পরেই ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮–৬৬৫ খ্রি.) শূন্য আবিষ্কার করেন এবং এই শূন্যকে ব্যাপকভাবে আলোচনার শীর্ষে নিয়ে আসেন। আগেই জেনেছি, প্রাচীন মিসরীয় সংখ্যাগুলো ছিল দশভিত্তিক। তাদের সংখ্যাগুলো স্থানভিত্তিক না হয়ে চিত্রভিত্তিক ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৪০ সালের দিকে মিসরীয়রা আয়কর ও হিসাবরক্ষণের জন্য শূন্যের ব্যবহার শুরু করে। তাদের চিত্রলিপিতে একটি প্রতীক ছিল, যাকে ‘নেফর’ বলা হতো, যার অর্থ হলো ‘সুন্দর’। প্রতীকটি তারা শূন্য এবং দশকের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করত। প্রাচীন মিসরীয় পিরামিড ও অন্যান্য স্থাপনায় এ ধরনের সংখ্যার ব্যবহার পাওয়া যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি ব্যাবিলনীয় গণিতবিদেরা শূন্য সংখ্যাটির অভাবে ছয়ভিত্তিক সংখ্যার মধ্যে একটি খালি ঘর রেখে পূরণ করত। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে দুটি যতিচিহ্ন প্রতীক এই ফাঁকা জায়গা দখল করে নেয়। প্রাচীন মেসোপটেমীয় শহর সুমের থেকে প্রাপ্ত একত্ব শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে প্রাচীন লেখক বেল বেন আপ্লু তার লেখায় দুটি যতিচিহ্ন প্রতীক ব্যবহারের বদলে একই ‘হুক’ দিয়ে শূন্যকে প্রকাশ করেছেন। ব্যাবিলনীয় শূন্যটি প্রকৃতপক্ষে শূন্য হিসেবে গণ্য করা সমীচীন হবে না, কারণ, এই প্রতীককে স্বাধীনভাবে লেখা সম্ভব ছিল না, কিংবা এটি কোনো সংখ্যার সঙ্গে বসে দুই অঙ্কবিশিষ্ট অর্থবোধক সংখ্যা প্রকাশ করত না।