পৃথিবীটা ব্যাকবেঞ্চারদের দখলে: দেবী শেঠি

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন দেবী প্রসাদ শেঠি। মেডিকেল কলেজেও প্রথম দফায় ভর্তি হতে পারেননি। এখন তিনি উপমহাদেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান হার্ট সার্জন। চেষ্টা, অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও বড় স্বপ্ন দেখার সাহস তাঁকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। নারায়ণা হেলথ নামে একটি হাসপাতাল চেইন প্রতিষ্ঠা করেছেন এই ভারতীয় চিকিৎসক। নিজের সাফল্য-ব্যর্থতার গল্প দেবী শেঠি শুনিয়েছিলেন ২০১৮ সালে, ভারতের অষ্টম যুব সম্মেলনে।

দেবী শেঠি

সব ক্লাসেই এমন কিছু ভালো ছাত্র থাকে, যারা শিক্ষকের প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দেওয়ার জন্য হাত তুলে ফেলে। ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চাররা ওদের দেখে ভাবে, এরাই বুঝি একদিন জীবনে সফল হবে, পৃথিবী বদলে দেবে। প্রথম সারির ওই শিক্ষার্থীরা স্বর্ণপদক জেতে, শিক্ষকের আদর-ভালোবাসা পায়, এরপর স্কুল-কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো র‌্যাঙ্কিংও পায়। এরা সফল না হলে কারা হবে? এমনটাই ভাবে সবাই। কিন্তু সত্যি বলতে আমরা যা মনে করি, বাস্তবতা তার চেয়ে আলাদা। আদতে পৃথিবীটা ব্যাকবেঞ্চারদের দখলে।

দুনিয়াজুড়ে অনেক গবেষণা, জরিপ, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্কুল-কলেজে অঙ্ক, বিজ্ঞান, অর্থনীতির জটিল সমস্যার সমাধান না করতে পেরে পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থীরা ফেল করত, তারাই পরে নিজেদের মেধা, অধ্যবসায় আর দক্ষতা দিয়ে কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছে। কোনো ব্যর্থতা, পরীক্ষায় পাওয়া কোনো নম্বর বা সনদ তোমাদের পথকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না। একমাত্র চিন্তার সীমাবদ্ধতাই আমাদের দমাতে পারে। তাই আমি বলব, তোমরা শুধু তোমাদের লক্ষ্যকে সুদূরপ্রসারী রাখো।

তোমাদের মধ্যে কয়জন ক্লাস টুতে ফেল করেছ? আমি করেছিলাম। ফেল করা কী? ব্যর্থতা কাকে বলে? এসব বোঝার বয়স হওয়ার আগেই আমি ব্যর্থ হতে শুরু করি।

আজ ব্যাকবেঞ্চার নিয়ে কথা বলছি, তাই তোমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে—আমি, দেবী শেঠি কোন বেঞ্চের ছাত্র ছিলাম? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। আমিও একজন ব্যাকবেঞ্চার। তোমাদের মধ্যে কয়জন ক্লাস টুতে ফেল করেছ? আমি করেছিলাম। ফেল করা কী? ব্যর্থতা কাকে বলে? এসব বোঝার বয়স হওয়ার আগেই আমি ব্যর্থ হতে শুরু করি। আমার শিক্ষক আমার রেজাল্ট দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি তো ব্যর্থ!’ ওই ক্লাসের একমাত্র ফেল করা ছাত্র ছিলাম আমি। মেডিকেল কলেজে ভর্তির বেলায়ও প্রথম দফায় চান্স পাইনি। দ্বিতীয় দফায় কোনোভাবে টেনেটুনে সুযোগ পেয়েছিলাম। মেডিকেল কলেজের প্রথম বছরটা ভীষণ কষ্টে কেটেছিল। সে সময় রাত–দিন পরিশ্রম করেছি, বারবার হোঁচট খেয়েও চেষ্টা চালিয়ে গেছি। ওই সময়েই ঠিক করেছিলাম, হার্ট সার্জন হব। নিজেকে তখন থেকেই বোঝাতাম, পরীক্ষায় খারাপ করতে পারি, কিন্তু হার্ট সার্জন হিসেবে সেরা হয়েই ক্ষান্ত হব।

ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই

পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। এখনো প্রায় রাতে স্বপ্নে দেখি, পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে পারছি না। কিংবা পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারছি না। পরীক্ষার ভয় এখনো আমাকে তাড়া করে। আমি নিশ্চিত, আরও অনেকেরই এটা হয়। তবে এই পরীক্ষার ভয় জীবনের দৌড়ে কোনো প্রভাব ফেলে না। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় খারাপ করলেও আমি আত্মবিশ্বাসী যে হার্ট সার্জারিতে আমাকে কেউ পেছনে ফেলতে পারবে না। এই একটা কাজই আমি ভালো পারি, তাই এটা নিয়েই আমার সব আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম আর স্বপ্ন দেখা। তোমরাও যে যেটায় ভালো, সেটার চর্চা করে যাও, সেটা নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখো। দেখবে জীবনে যেখানে পৌঁছতে চাও, তোমার অধ্যবসায় তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাবে।

আমাদের সমাজের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান চাইলেই আমরা খুব সহজে আমাদের আশপাশ থেকেই খুঁজে বের করতে পারি। এ জন্য ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদের মধ্য থেকে বের করা যায়।

১৫ বছর আগে ভারতের কর্ণাটকে ভয়াবহ খরা হয়েছিল। সব হারানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার কৃষকেরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেন। অপুষ্টি, অসুস্থতায় অনেকে প্রাণ হারাতে শুরু করেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় অনেক প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারটাও তাঁরা করাতে পারতেন না। ভাবলাম, এমন একটা কিছু করা দরকার, যেন খুব প্রয়োজনীয় অপারেশনটা অন্তত কৃষকেরা করাতে পারেন, টাকার অভাবে কারও অস্ত্রোপচার যেন থেমে না থাকে। তখন আমি স্থানীয় সরকারের সাহায্যে ১৭ লাখ কৃষককে প্রতি মাসে মাত্র ৫ রুপি করে প্রিমিয়াম দেওয়ার শর্তে যেকোনো ধরনের অপারেশনের সুবিধা ভোগ করার ব্যবস্থা করে দিই। যশোশ্বনী মাইক্রো হেলথ কেয়ার স্কিম নামে ওই কর্মসূচির আওতায় এখন কর্ণাটকে ৪০০ হাসপাতাল থেকে ৪০ লাখ কৃষক নানা ধরনের অপারেশনের সুবিধা পাচ্ছেন।

এই গল্প বলার কারণ হলো, আমাদের সমাজের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান চাইলেই আমরা খুব সহজে আমাদের আশপাশ থেকেই খুঁজে বের করতে পারি। এ জন্য ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদের মধ্য থেকে বের করা যায়।

যে কথা বহু পুরোনো

নিশ্চয়ই জীবনের কোনো না কোনো সময় আমরা প্রত্যেকেই শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনেছি—আমরা কতটা অমনোযোগী, কতটা অযোগ্য, অপদার্থ! তোমাদের একটা উক্তি শোনাই—‘আজকালকার ছাত্ররা পড়াশোনায় মোটেই মনোযোগী না। শিক্ষাকে এরা গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। তারা বাড়ির কাজ তো করেই না, শিক্ষকদের সম্মানও করে না।’ এই উক্তি নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনেছ? কিন্তু এই কথা তোমার শিক্ষক একা বলেননি। এটা কবে প্রথম বলা হয়েছিল জানো? ইতিহাস বলে, এটি মনীষী হিপোক্রিটিসের উক্তি, ৪৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ কথা বলেছিলেন তিনি। অর্থাৎ যে কথা শুনে শুনে তোমরা এখন হতাশ হচ্ছ, নিজেদের ব্যর্থ মনে করছ, সেই কথা যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৪৬০ বছর আগে থেকে ছাত্ররা শুনে আসছে। তাই তোমার শিক্ষকেরা যখন তোমাকে বলবে, ‘তুমি তোমার জীবন নিয়ে একদম সিরিয়াস না’ হতাশ হোয়ো না। আর ভুলেও কখনো হাল ছেড়ো না। এটা নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথা। তুমি তোমার নিজের গতিতে, নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাও। কোনো কথা যেন তোমাকে দমাতে না পারে। বড় স্বপ্ন দেখো, সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলো। (অংশবিশেষ)

ইংরেজি থেকে অনুদিত

সূত্র: লিড ক্যাম্পাসের ইউটিউব চ্যানেল