শিক্ষায় বড় পরিবর্তন

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ

যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ।

প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি গত সোমবার অনুমোদন দিয়েছে সরকার
ফাইল ছবি

শিক্ষার্থী মূল্যায়নে বড় পরিবর্তন এনে প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, সেটিকে ভালো ও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই। কিন্তু তাঁরা এ–ও বলেছেন, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় সারা দেশে এই শিক্ষাক্রম কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটা বড় চ্যালেঞ্জ।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষকেরা। অথচ এখন পর্যন্ত দেশে শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। আবার শিক্ষকদের একটি বড় অংশের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে। তাই যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি দক্ষতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি গত সোমবার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা রাখা হয়নি। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক, নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে। প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। পুরোটাই মূল্যায়ন হবে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বাকি শ্রেণিগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে কিছু মূল্যায়ন শিখনকালীন কার্যক্রমের ভিত্তিতে এবং কিছু অংশের মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে হবে। আগামী বছর থেকে তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে। ২০২৩ সাল থেকে তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে।

শিক্ষার মান উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজের সঙ্গে যুক্ত কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থায় যেতেই হবে। শিক্ষার্থীদের পাঠদানে শিক্ষকের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। সর্বোচ্চ ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক থাকলে ভালো হয়। শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে, তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়াতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাবে দেশে সরকারি, কিন্ডারগার্ডেন, এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২ কোটি। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জন। শিক্ষার্থী ১ কোটি ৪১ লাখ ৪৪৫ জন। এই হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সারা দেশে গড়ে ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ৩৯ জনের মতো শিক্ষার্থী আছে।

২০ হাজার ৬০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন। আর শিক্ষক ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। অর্থাৎ ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী প্রায় ৪২ জন। দেশে ৪ হাজার ৫৫১টি কলেজে মোট শিক্ষার্থী ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ২১০। আর শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৭ জন।

নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলাকালে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে সারা বছর ধরে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। আর প্রথম সাময়িকী, দ্বিতীয় সাময়িকী বা অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে যে মূল্যায়ন হয়, সেটাকে সামষ্টিক মূল্যায়ন বলা হয়; যা অপেক্ষাকৃত গতানুগতিক ও সহজ। কিন্তু ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য অধিক যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রয়োজন।

নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে। এ জন্য তাঁরা শিক্ষকদের সক্ষমতা তৈরিতে নানা পর্যায়ের সুপারিশ করেছেন।

জানা গেছে, আগামী বছর পরীক্ষামূলক শিক্ষাক্রম শুরুর সঙ্গে সারা দেশে শিক্ষক গাইড ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে বলা হয়েছে। এরপর ২০২৩ সালে গিয়ে শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণে এই বিষয়ও যুক্ত হবে। এই সময়ে যে শিক্ষকেরা অবসরে যাবেন, তাঁদের স্থলে নতুন শিক্ষক নিয়োগ করে নতুন ব্যবস্থায় প্রশিক্ষিত করতে হবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষকের সব ধরনের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিষয়টি যুক্ত করা হবে।

শিক্ষকদের যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, তা করা হবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান।

যদিও এর আগে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল, শিক্ষাব্যবস্থায় চালু হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতি; কিন্তু সেগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখনো গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক ভালো দিক আছে। শিক্ষাবিদদের পরামর্শ এবং বিভিন্ন গবেষণার উঠে আসা বিষয় গ্রহণ করা হয়েছে। এ জন্য স্বাগত জানাই। এখন পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন না করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, এর আগে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত দক্ষ করতে না পারায় সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’