ক্যামেরা হাতে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন তিনি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের বেদিতে সাঁটানো প্রতিবাদী পোস্টার। সামনে এক নারী—যেন সব বাধা অতিক্রম করে তেড়েফুঁড়ে উড়ে যাচ্ছেন! দেশের শিক্ষাঙ্গনের অস্থির সময়ে এই ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘দেয়ালে দেয়ালে’। অনেকেই হয়তো জানেন না ক্যামেরার সামনের চেয়ে পেছনের ছবিটা আরও চমকপ্রদ, আরও অনুপ্রেরণাদায়ী। পড়ুন ছবিটির আলোকচিত্রী জয়িতা তৃষা ও মডেল মুবাশশীরা কামালের সাক্ষাৎকার

জয়িতা তৃষার তোলা এই ছবিই ভাইরাল হয়েছে নেট দুনিয়ায়

ছবি তুলি নিজের জন্য: জয়িতা তৃষা

ঢাকার রাস্তায় ব্যালের ভঙ্গিতে তোলা এই ছবির পরিকল্পনা কীভাবে মাথায় এল?

আমার খুব প্রিয় একজন ব্রাজিলীয় আলোকচিত্রী আছেন, নাম মারিনহো। ব্যালে নিয়ে তাঁর বেশ কিছু কাজ আছে, যা আমাকে অনুপ্রাণিত করত। চাইতাম এমন একটা কিছু করব। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যালের চর্চা কম, শিল্পীও পাচ্ছিলাম না। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে সাগর নামের একটা ছেলে ছিল। একদিন হঠাৎ দেখলাম সে একটা মেয়েকে নিয়ে এ রকম ব্যালে মুভমেন্টের ছবি তুলেছে। জানলাম মেয়েটার নাম ইরা (মুবাশশীরা কামাল)। এভাবেই যোগাযোগ। ইরাকে শুরুতে মারিনহোর তোলা ছবি দেখালাম। সে বলল, ‘আপু, ঢাকার রাস্তায় এটা কীভাবে সম্ভব?’ আমি বললাম, ‘সম্ভব। বরং এটাই আরও মজার হবে।’

তারপর ছবি তুলতে গিয়ে কি সত্যিই ‘মজা’ হলো?

মজা তো হয়েছেই। ঢাকার রাস্তায় যা হয়, মানুষজন তাকিয়ে থাকে। যে ছেলেটার কথা বলছিলাম, সাগর, সে-ও ছিল আমাদের সঙ্গে। রাজু ভাস্কর্যের সামনে যখন ছবি তুলছিলাম, সাগরকে রীতিমতো ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।

আলোকচিত্রী জয়িতা তৃষা

ফেসবুকে আপলোড করার সময় কি ভেবেছিলেন ছবিটা এমন ভাইরাল হবে?

আগেও ইরাকে নিয়ে এ রকম একটা সিরিজ করেছি ধানমন্ডি লেকে, সেটাও মানুষ পছন্দ করেছে। এবারেরটাও ভাবছিলাম পছন্দ করবে। কারণ, রাজু ভাস্কর্য, ওর জামার রং, তার ওপর শীতের সকালের একটা নীলচে টোন আছে। যখন দেখলাম ভাস্কর্যের সামনে বিভিন্ন প্রতিবাদী ব্যানার লাগানো, মনে হলো ছবিটা আরও অর্থবহ হবে। ইরা ওর মতো নেচে গেছে। আমি একের পর এক শট নিয়ে গেছি।

মুবাশশীরা কামাল ইরা

অনেকে বলেছেন আপনি শাবিপ্রবির আন্দোলনটা ভিন্নভাবে দেখিয়েছেন এই ছবির মধ্য দিয়ে...

আমার মাথায় আসলে সে রকম কিছু ছিল না। আমি আলোকচিত্রী। নিজের জন্য কাজ করি। শুধু ফটোগ্রাফির সৌন্দর্যটাই দেখাতে চেয়েছি। কেউ ভাবতে পারে এটা মেয়েদের স্বাধীনতার প্রতীক। কেউ ভাবতে পারে আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি। যে যেভাবে ভেবে নেয়।

কেমোথেরাপিগুলো খুব কষ্টের ছিল। প্রথম ৪টা কেমো ১২ দিন বিরতি নিয়ে দিতে হতো। পরের ৪টার একেকটার মাঝখানে বিরতি ছিল ২১ দিনের। ওই ২১ দিনও আমি কাজ করেছি। প্রথম সাত দিন বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না। আট দিনের দিন যখন বিছানা থেকে উঠতাম, তখনই মনে হতো আমি একটু ছবি তুলি।
জয়িতা তৃষা, আলোকচিত্রী

ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনীর কোনো ভাবনা আছে?

আমি আসলে একটু আড়ালে থাকা মানুষ। জনপ্রিয়তা চাই না। অনেক দিন সবকিছু থেকে দূরে ছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস খুব কম। মানুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। খুব ‘অ্যাংজাইটি’ হয়। মনে হয় সবাই খুব স্বাভাবিক, আমিই মনে হয় অস্বাভাবিক।

মুবাশশীরা কামাল ইরা

ক্যানসারের সঙ্গে একটা কঠিন লড়াই আপনাকে করতে হয়েছে বলে শুনেছি।

এটা আমি আসলে কাউকে বলিনি। গত বছর মার্চে আমার ক্যানসার ধরা পড়ে। গত মাসে আবার টেস্ট করা হলো। সেই টেস্টে দেখাচ্ছে এখন আমি ক্যানসারমুক্ত। কিন্তু সমস্যা হলো, আমার তো ‘অ্যাগ্রেসিভ ক্যানসার’, সুতরাং দুই বছরের মধ্যে আবার ফিরে আসার আশঙ্কা আছে। সেটা যেন না হয়, সে জন্য আমাকে ইমিউনোথেরাপি নেওয়া লাগছে। ইমিউনোথেরাপি ভীষণ ব্যয়বহুল। একেকটা ইনজেকশনের দাম ৮০ হাজার টাকা। কয়েকটা নিয়েছি, আরও অনেকগুলো বাকি।

ছবি তোলার আনন্দটা কি আপনাকে ‍সুস্থ হতে সাহায্য করছে?

সত্যিই। যদি এটা না থাকত, আমার মনে হয় এই লড়াইয়ে আমি খুব ভেঙে পড়তাম। কেমোথেরাপিগুলো খুব কষ্টের ছিল। প্রথম ৪টা কেমো ১২ দিন বিরতি নিয়ে দিতে হতো। পরের ৪টার একেকটার মাঝখানে বিরতি ছিল ২১ দিনের। ওই ২১ দিনও আমি কাজ করেছি। প্রথম সাত দিন বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না। আট দিনের দিন যখন বিছানা থেকে উঠতাম, তখনই মনে হতো আমি একটু ছবি তুলি। ক্যামেরাটা নিয়ে বের হতাম। কিছু না পারলে বাসার ছাদে গিয়ে ছবি তুলতাম। রাস্তায় তো পারব না, কারণ, শরীর ভীষণ দুর্বল। দেখা গেল বৃষ্টি হচ্ছে...আচ্ছা, বাসার নিচে দাঁড়িয়েই নাহয় কয়েকটা ছবি তুলি। সবার বাহবা তো আমার দরকার নেই। আমি ছবি তুলি নিজের শান্তির জন্য।

মুবাশশীরা কামাল ইরা

আপনার ছবিতে এই যে একটা মেয়ে উড়ে যেতে চাইছে, এটা কি কোনোভাবে আপনার মনেরই প্রতিফলন?

অনেকটা। আমি নিজেকে যেভাবে ক্যামেরার সামনে দেখতে চাই, আমি মানুষটা যেমন, আসলে ক্যামেরায় আমি সেই ছবিটাই আনার চেষ্টা করি।

পরের কাজ নিয়ে কী ভাবছেন?

আমি আসলে কাজের মধ্যে একঘেয়েমি আনতে চাই না। ঢাকাকে তুলে ধরব নিশ্চয়ই। কিন্তু একটু অন্যভাবে। একটা গরিব-দুঃখী ঢাকা আমি দেখাতে চাই না।

‘ইউটিউব দেখে ব্যালে শিখেছি: মুবাশশীরা কামাল

আপনি তো শিক্ষার্থী। কোথায় পড়ছেন?

আমি নওগাঁ সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছি।

ব্যালে শেখার আগ্রহ হলো কেন?

ছোটবেলা থেকে আমি ভরতনাট্যম শিখেছি, এখনো শিখছি। ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন নাচের দলের সঙ্গে কাজ করেছি, করছি। তবে ইউটিউব কিংবা ‘আমেরিকাজ গট ট্যালেন্ট’ অনুষ্ঠানটি দেখে দেখে ব্যালের প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এখানে ছন্দ, শরীরের নমনীয়তার একটা ব্যাপার আছে। এটা খুব আকর্ষণ করত। তাই করোনার সময়ে ইউটিউব দেখে দেখে শেখার চেষ্টা করেছি।

মুবাশশীরা কামাল ইরা

বাসায় একা একা কীভাবে ব্যালের চর্চা করেছেন?

বাসায় আমার কোনো ইয়োগা ম্যাট ছিল না। আর ঘরের ভেতর জায়গা খুব কম। আমার মা বসার ঘর থেকে টেবিল, সোফা সব বের করে জায়গা করে দিয়েছেন। প্রথম দিকে চর্চা করতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছি, পায়ের নখ উঠে গেছে, হাঁটু ছিলে গেছে। কখনো কখনো কোমরে বা পায়ে ব্যথা হতো। তখন আমি চর্চা বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু আম্মু আমাকে একটা কথা বলত, ‘ব্যথার ওপরে ব্যথা দাও, একদিন দেখো ঠিক হয়ে যাবে।’ সেই সময়টা অনেক কঠিন ছিল।

আলোকচিত্রী জয়িতার সঙ্গে এই প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

দারুণ। ব্যালের নির্ধারিত জুতা আছে। সেটা আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। ঢাকার রাস্তায় যেখানে খালি পায়ে হাঁটাই কঠিন, সেখানে এক আঙুলের ওপর ভর করে নাচা আরও কষ্টকর। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে আমি সার্থক। সবাই আমাকে খুব সুন্দর করে গ্রহণ করেছে।

সামনের দিনগুলো নিয়ে কী ভাবছেন?

আমার স্বপ্ন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। এ ছাড়া নাচ নিয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা আছে।