রাকিবুল বিশ্বাসের বাড়ি সুন্দরবনের কাছেই। খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের সত্যপীর গ্রামে। পড়ছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল (ইসিই) বিভাগে। তবে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছানোর পথটা সহজ ছিল না মোটেও।
বাবা কাঠমিস্ত্রি। ছয় সদস্যের পরিবারের ভার একার কাঁধে নেওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন রাকিবুল। বিনা বেতনে, স্রেফ খাবারের বিনিময়ে মুদিদোকানে কাজও করেছেন কিছুদিন। তখন স্বপ্ন দেখতেন, একদিন নিজের একটা দোকান হবে। পড়ালেখাটা আবার শুরু করার প্রত্যয়ও ছিল মনে।
তিন বছর বিরতির পর, ২০১০ সালে আবার সপ্তম শ্রেণিতেই ভর্তি হন রাকিবুল। কাজের পাশাপাশি চালিয়ে যান পড়ালেখা। তত দিনে আগের সহপাঠীরা স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে, কিন্তু কয়েকজন শিক্ষক ঠিকই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। চলতে থাকে পড়াশোনা, পাশাপাশি কাঠমিস্ত্রির কাজ। এরপর জেএসসিতে মেধাবৃত্তি আর এসএসসিতে জিপিএ–৫ পাওয়ায় প্রতিকূলতার মধ্যেও লেখাপড়াটা আর বন্ধ হয়নি।
রাকিব বলছিলেন, ‘২০১৪ সালে শহরের কলেজে ভর্তি হই। একটা শিক্ষাবৃত্তি আর টিউশনি ছিল ভরসা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও টিউশনি করেছি। নিজের খরচ মিটিয়ে সহায়তা করেছি পরিবারকেও।’
টিউশনি, রুয়েটে পড়ালেখা—সব ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনার আঘাত আবার সব ওলট–পালট করে দেয়। গত বছরের মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়। ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে ছুটি। টিউশনিও বন্ধ হয়ে যায় রাকিবের। উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়ে গ্রামে ফিরে যান। এদিকে বাবার কাঠমিস্ত্রির কাজ তখন প্রায় বন্ধের পথে। অভাব আবারও জেঁকে বসে পরিবারে।
রাকিব দেখলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গার তরুণ উদ্যোক্তারা অনলাইনে ব্যবসা করছেন। চট করে তাই ভাবনাটা মাথায় এল। যেহেতু সুন্দরবনের পাশেই বাড়ি আর বনের প্রাকৃতিক মধুর সঙ্গে পরিচিতি জন্মলগ্ন থেকেই; তাই এ সময়ে খাঁটি মধু সংগ্রহ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে তো উপার্জন করা সম্ভব।
রাকিব কাজ শুরু করে দেন। গত বছরের জুনে ফেসবুকে ‘আহরণ-Ahoron’ নামে একটি পেজ খুলে ফেলেন। স্লোগান ঠিক করেন—আপনার বিশ্বাস, আমাদের দায়বদ্ধতা। এরপর মৌয়ালদের থেকে সরাসরি মধু নিয়ে প্রাকৃতিকভাবে তা সংরক্ষণ করেন। খাঁটি মধু পৌঁছে দেন গ্রাহকের কাছে।
শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বড় ভাই-আপুরাই ছিলেন ক্রেতা। পরে মুখে মুখে নাম ছড়িয়ে পড়ে। এখন প্রায় প্রতিদিনই অর্ডার আসে। কুরিয়ারের মাধ্যমে ‘আহরণ’–এর মধু পৌঁছে যায় সারা দেশে। রাকিব বলেন, ‘প্রতি মাসে সুন্দরবনের খলিশা, বাইন, গরান চাকের মধু প্রায় ৭০ কেজি বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।’
নিজে অভাব–অনটনে বড় হয়েছেন বলেই দুস্থ মানুষের কষ্টটা রাকিবুল বিশ্বাস বোঝেন। উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি তাই করোনাকালে গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এবং ব্যবসার লাভের অংশ থেকে নিজ গ্রামের ১২২টি পরিবারকে কয়েক ধাপে খাদ্যসহায়তা দিয়েছেন। ‘করোনাকালীন পাঠশালা’ নামে বাড়িতে গ্রামের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়িয়েছেন এই তরুণ।
ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে, তাই রাকিব ফিরেছেন রাজশাহীতে। ওদিকে ব্যবসাও চলছে পুরোদমে। শুরুর দিকে গ্রাম থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে, খুলনা শহরে এসে সপ্তাহে দুই দিন কুরিয়ার করতে হতো। এখন অর্ডারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় শহরের গল্লামারী এলাকায় ব্যবসার কাজে ঘর ভাড়া করেছেন তিনি। পরীক্ষিত ও নিজস্ব মৌয়ালদের কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করে আনা ও বোতলজাত করে কুরিয়ার করার জন্য দুজন কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন। তবে হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপণনের কাজটা একাই সামলাচ্ছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও চার শিক্ষার্থী ‘কমিশন এজেন্ট’ হিসেবে রাকিবের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
রাকিব বললেন, ‘যখন আমার কাছ থেকে মধু নিয়ে গ্রাহকেরা ইতিবাচক মন্তব্য করেন, সাহস দেন, সততার সঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দেন; তখন উৎসাহ বেড়ে যায়। “আহরণ” একদিন বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড হয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু পৌঁছে দেবে, এই স্বপ্নই দেখি।’