আমরা এগোব আত্মবিশ্বাস নিয়ে

মডেল: মেহরীন ও মাহি
ছবি: কবির হোসেন

কোভিড মহামারি আমাদের বিপর্যস্ত করেছে। অর্থনীতি থেকে নিয়ে জনজীবন, সবখানেই পড়েছে এর আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু মহামারি অন্তে ঘুরে দাঁড়াতে অর্থনীতির খুব একটা সময় লাগবে না, সমাজজীবনও গতিশীল হতে শুরু করলে ক্ষতগুলো দ্রুতই সারবে। শুধু সময় লাগবে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে। শুধু মহামারির কারণে যেসব ক্ষতি হলো—দেড়টা বছর হারিয়ে গেল, ডিজিটাল বৈষম্য প্রকট হলো, অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়ল, আরও বহু শিক্ষার্থী মানসিক অবসাদে ভুগল অথবা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলল—তা নয়, এসবের বাইরেও এই সময়ের শিক্ষা যা দাবি করে, সেগুলো মেটানোতে আমাদের অপারগতাকে একই সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।

কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এ দেশের মানুষ সারা ইতিহাসজুড়ে দুর্যোগের সঙ্গে ঘর করেছে। প্রাকৃতিক হোক, মানুষের সৃষ্ট হোক—যেকোনো দুর্যোগের ঝাপটা কীভাবে সামাল দিতে হয়, মানুষ তা জানে। এ দেশের প্রকৃতিও জানে। ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণের উপকূল ছিন্নভিন্ন হলো, সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চলল। দুই বছর পর দেখা গেল জীবন চলছে আগের মতোই। সুন্দরবন তার শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। আরও যেন সুন্দর হলো।

ক্ষতি এবং ক্ষত অবশ্য ভুলে যাওয়ার নয়। চলে যাওয়া মানুষ ফিরে আসে না। কিন্তু তাদের জন্য শোকটা কোথায় যেন শক্তি জোগায়।

মহামারিও একদিন আমরা জয় করব। শিক্ষার ক্ষতিটা পুষিয়ে নেব। আগামীর জন্যও তৈরি হব। সবাই এই উঠে দাঁড়ানোতে শামিল হতে পারবে না, সে জন্য তাদের কথা ভেবেও আমাদের এগোতে হবে।

কীভাবে এগোব? এগোব আত্মবিশ্বাস নিয়ে, আন্তরিকতা নিয়ে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, পরিশ্রম আর অধ্যবসায়কে সঙ্গে করে।

মাত্র কিছুদিন হলো স্কুল–কলেজ খুলেছে, সবাই এখনো যদিও ক্লাস শুরু করতে পারেনি। কিন্তু কজন শিক্ষক আমাকে বললেন, শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস উঁচু। শুধু শহর নয়, গ্রামেও। ১৯৭১ সালে সারা বছর পড়ালেখা হয়নি। স্বাধীনতার পর এক বছরে আমরা ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠলাম। তার পেছনে ছিল আত্মবিশ্বাস—আমরা পারব।

কোভিড মহামারি ব্যাপক হওয়ার সময় আমার মনে হয়েছিল, মানুষকে এই দুর্যোগ হয় আরও স্বার্থপর করবে—যেহেতু সবাই আপন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, প্রতিবেশীর দিকে নজর দেওয়া হবে না; অথবা মানুষ আরও মানবিক হবে। এখন দেখতে পাচ্ছি স্বার্থপরতাটা পশ্চিমেই বেশি দেখা গেছে। সেখানে যুক্তিতর্কও কুসংস্কার ও বিদ্বেষী রাজনীতির কাছে মার খাচ্ছে। সে তুলনায় স্বার্থপরতার প্রকাশ পুবে কম। আমরা যে খুব মানবিক হয়েছি তা নয়, কিন্তু ভয়ানক অমানবিকও হয়ে যাইনি। এটি আমাদের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি হতে দেয়নি। আমার ভরসার জায়গাটা এ দেশের তারুণ্য। তরুণেরা দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বিপন্নদের সহায়তা দিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই তরুণ, অথবা কৈশোর-তারুণ্যে শিগগিরই বেড়ে ওঠার পথে। আত্মবিশ্বাসটা হবে সক্ষমতা নিয়ে। মাত্র কিছুদিন হলো স্কুল–কলেজ খুলেছে, সবাই এখনো যদিও ক্লাস শুরু করতে পারেনি। কিন্তু কজন শিক্ষক আমাকে বললেন, শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস উঁচু। শুধু শহর নয়, গ্রামেও। ১৯৭১ সালে সারা বছর পড়ালেখা হয়নি। স্বাধীনতার পর এক বছরে আমরা ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠলাম। তার পেছনে ছিল আত্মবিশ্বাস—আমরা পারব।

মডেল: মেহরীন ও মাহি

আন্তরিকতার অর্থ খোলা মন নিয়ে কাজের সামনাসামনি হওয়া। নিজের প্রতি সৎ হওয়া। একজনের ঘাটতি আরেকজন মাপতে পারে না—সেটি দূর করতে সাহায্য যদিও করতে পারে। যদি আমরা নিজেদের সঙ্গে, একে অপরের সঙ্গে, শিক্ষকদের সঙ্গে আন্তরিক হই, তাহলে কোথায় ঘাটতি এবং কীভাবে সেগুলো মেটানো যায়, সেই ধারণাটা পরিষ্কার হবে। একজন আরেকজনকে করতে পারব।

যাঁদের সামর্থ্যের অভাব আছে, তাঁদের ডিজিটাল দুনিয়ায় পা রাখা বা চলাফেরাটা সম্ভব হয়নি। সেই বৈষম্য কীভাবে দূর করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। একজন যে কম্পিউটারে পারদর্শী, সে যদি বৈষম্যের শিকার বন্ধুকে সাহায্য করে, তাহলে শুধু বন্ধুটির যে উপকার হবে তা নয়, নিজেকে সে আরেকটু উঁচুতে তুলে নিতে পারবে। মনে রাখতে হবে, এই উঁচুতে না উঠতে পারলে পৃথিবীর মাপে আমরা পিছিয়ে থাকব।

ডিজিটাল জ্ঞানটা খুব জরুরি, কিন্তু ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বা মোবাইলের ডেটা যেন আমরা ফেসবুক ঘুরে বেড়িয়ে বা গেম খেলে নষ্ট না করি। এ হবে ঘোরতর অপচয়, অন্যায়ও।

অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের তো কোনো বিকল্প নেই। এখন তিন দিনের পড়া এক দিন পড়তে হবে। না, শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য নয়। বরং নিজেকে গোটা পৃথিবীর সক্ষমদের কাতারে দাঁড় করানোর জন্য।

আমরা পারব। কষ্ট হবে, কিন্তু পারব। কেউ যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখে, তা বাস্তবে নামিয়ে আনতে একটা শক্তিও পায় নিজের মধ্যে। আমরা ক্লাসে ফিরে যাব এবং ভাবব—বা একটা বাস্তব স্বপ্ন দেখব—ভবিষ্যতের এ রকম কোনো মহা দুর্যোগে পথ দেখাবে বাংলাদেশ। দুর্যোগের রকম অনুযায়ী প্রতিরোধ তৈরি করে, বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে, মেধার স্বাক্ষর রেখে, অধ্যবসায় এবং পরিশ্রমের প্রয়োগ ঘটিয়ে।

আমার শিক্ষকতাজীবন বাংলাদেশের প্রায় সমান বয়সী। আমি তরুণদের কাছে থেকে দেখেছি, এখনো দেখছি। আমি জানি তারা চাইলে অসাধ্যসাধন করতে পারে।