ফেসবুকে ছবি না দিলে টিকা কাজ করে না, বলি কেন

ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানসিক উদ্বেগের বড় কারণ
রয়টার্স

বছর দেড়েকের বেশিই হবে বোধ হয়। এক শীতের সকালে খুলনার কয়রায় ট্রলারে চেপে বসলাম। শুরু হলো আমাদের যাত্রা। টানা তিন দিন কাটাব সুন্দরবনে। যাত্রার শুরুতেই বারবার বলা হলো, আর কিছুটা এগোলেই ফোনে নেটওয়ার্ক থাকবে না। এখন যাত্রা যার, কল করার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

সেই সতর্কবার্তায় আমাদের কারও মধ্যে সতর্কতার ছিটেফোঁটা দেখা গেল না। উল্টো আনন্দ যেন ধরে না। ‘অবশেষে নিজের মতো করে কাটানোর জন্য সময় পাওয়া গেল’, ‘আমার আমি’, ‘চলে গেলাম নেটওয়ার্কের বাইরে’ ইত্যাদি।

নেটওয়ার্কের বাইরে প্রথম দিন ভালোই কাটল। তবে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যা থেকে মন কেমন কেমন করে। তৃতীয় দিন শেষে নেটওয়ার্কে ঢুকে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। খুলনায় হোটেলে ফিরে ফোন চার্জে দিয়ে বসে গেলাম ফেসবুক নিয়ে। নিউজফিড যেন আর শেষই হয় না।

‘ডিলিট ফেসবুক’ দিয়ে লেখা শুরু করা যেত। তবে সেটা খুব একটা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব বলে মনে হয় না। চমৎকার কিছু দেখলে এখনো ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করার কথাই প্রথম মাথায় আসে। তা ছাড়া অনুষ্ঠান খারাপ বলে টিভি তৈরির প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করাও ঠিক যৌক্তিক নয়।

আমরা বরং শিরোনাম নিয়ে আলোচনা করতে পারি। ফেসবুকে এখন প্রায়ই টিকা গ্রহণের ছবি দেখা যায়। একজন স্বাস্থ্যসেবাকর্মী টিকাগ্রহীতার শরীরে সুই ঢোকাচ্ছেন, এমন ছবি বারবার দেখতে চাই, তা বলতে চাই না। তবে ব্যাপারটা যদি অন্যদের টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে, তবে খারাপ কিছুও দেখি না।

অনেকেই সে ছবির ক্যাপশনে লিখছেন, ‘ফেসবুকে ছবি না দিলে টিকা কাজ করে না।’ ব্যাপারটা তাঁরা মজা করেই লিখছেন। টিকা কাজ করার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমরা যদি আরেকটু ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করি, ব্যাপারটি কেবল টিকা কিংবা ফেসবুকের নয়।

‘অ্যাটেনশন ইকোনমি’ বলে একটা কথা আছে। বাংলায় মনোযোগের অর্থনীতি বলা যেতে পারে। একবাক্যে বললে, দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বণ্টন কীভাবে হবে, তা-ই অর্থনীতি। আর মনোযোগ অর্থনীতিতে মনোযোগকে দুষ্প্রাপ্য বলে গণ্য করা হয়।

আমাদের চারপাশে তথ্যের এমনই প্রবাহ যে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইলে অন্যের চেয়ে আলাদা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ইদানীং টিকা প্রদান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে ঠিক। তবে কদিন আগেও তা ছিল দুষ্প্রাপ্য। আর প্রথম দফায় যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁরা তো ফেসবুকে ছবি দিতে চাইবেনই।

আচ্ছা, টিকার কথা আপাতত বাদ দিই। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যান্য ব্যবহার নিয়ে কথা বলি। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ যা করে আসছে, ফেসবুক কিন্তু সেই পথই সুগম করেছে। আর তা হলো, নিজের ভাব প্রকাশ ও যোগাযোগ।

কানাডার রায়েরসন ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত টেডএক্স বক্তৃতায় বেইলি পারনেল আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো আমাদের জীবনের ‘হাইলাইট’।

বেইলি পারনেলের ভিডিওটি দেখুন নিচে

ফেসবুকে বন্ধু যদি নায়াগ্রা ফলসের সামনে ছবি দেয়, তবে সেটা তার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর একটি। প্রতিদিন সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবন কারও জীবনের সুনির্বাচিত অংশের সঙ্গে তুলনার চেষ্টা করি। ফেসবুকের আগেও ব্যাপারটি ছিল। তবে এখন এ তুলনা আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সমস্যা বাধছে সেখানেই।

বেইলি পারনেলের ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করে চারভাবে।

প্রথমটি হলো, হাইলাইট রিল। যেটা একটু আগেই বললাম। দ্বিতীয়টি হলো, সোশ্যাল কারেন্সি। মুদ্রার মাধ্যমে আমরা কোনো কিছুর মূল্য নির্ধারণ করি। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের পরিমাণের মাধ্যমে কোনো কিছুর মূল্য নির্ধারণ করছি আমরা। সেটা পণ্যের ক্ষেত্রে মানা যায়। তবে ফেসবুকে আমরা, মানে ব্যবহারকারীরাই তো পণ্য। আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলোর মূল্য নির্ধারণে অন্যদের সুযোগ করে দিচ্ছি আমরা।

বেইলি পারনেলের আলোচনায় তৃতীয় মানসিক চাপ হলো ‘ফোমো’। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে না ঢুকলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পাব না, অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ব—মনে এমন দুশ্চিন্তা কাজ করে বলেই আমরা বারংবার ফেসবুকে ঢুকে থাকি। তবে এই তিনটির চেয়েও ভয়াবহ হলো অনলাইনে হয়রানি।

ফলাফল? উদ্বেগ আর হতাশা।

সমাধানের উপায়ও বাতলেছেন বেইলি পারনেল। তিনি বলেছেন, সমস্যা চিহ্নিত করাই সমাধানের প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ হলো, নিজে কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছি, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি, দিনে কতবার পোস্টে লাইক গুনছি, কেন গুনছি, তা বুঝতে চেষ্টা করা। আপনি যদি নিজেকে প্রশ্ন করে নিজের উত্তরে সন্তুষ্ট থাকেন, তবে কোনো সমস্যা নেই। আর সন্তুষ্ট না হলে বুঝতে চেষ্টা করুন, কী আপনার ওপর চাপ তৈরি করছে। এরপর সেগুলো ছাঁটাই করার পালা। সবশেষে নিজেকেও ভালো হতে হবে। আপনি যেন অন্য কারও হয়রানির কারণ না হন, সেদিকে নজর রাখতে হবে।