করোনা রোগীদের রক্ত জমাট বেঁধে যায় কেন?

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের কারও কারও রক্তবাহী নালিতে রক্ত জমাট বেঁধে জটিল সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, করোনা নেগেটিভ হয়ে গেলেও সমস্যা চলতে থাকে। অনেকের স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হয়। করোনামুক্ত হওয়ার পরও এ ধরনের জটিলতার কারণ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন।

সম্প্রতি স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনে (স্মিথসোনিয়ানম্যাগ ডটকম, ৩১ আগস্ট ২০২০) এ বিষয়ে একটি বড় নিবন্ধ ছাপা হয়েছে।

অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, যেহেতু কোভিড-১৯ রোগে রক্তবাহী নালির কোষগুলোর (ব্লাড সেল) ভেতরের আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই এর জের অনেক দিন ধরে চলতে থাকে। সেল ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর আবরণের টিস্যুগুলো সৃষ্ট ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য একধরনের প্রোটিন তৈরি করে। এর কাজ হলো রক্তের সঙ্গে মিশে কিছু রক্ত জমাট বেঁধে ফেলার (ব্লাড ক্লটিং) ব্যবস্থা করা। এটা দেহের একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। উদ্দেশ্য হলো ক্ষতিগ্রস্ত সেল যেন রক্তপ্রবাহের কারণে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে না পারে, সে জন্য রক্তনালির ওই অংশে একটি আবরণ তৈরি করা। ক্ষত সেরে গেলে সেই রক্তজমাট অংশ আবার ধীরে ধীরে মিশে যায়। সাধারণ ক্ষেত্রে এ রকমই হওয়ার কথা। কিন্তু অনেক সময় সেই জমাট বাঁধা অংশ রক্তপ্রবাহের টানে স্থানচ্যুত হয়ে ভেসে যায় এবং মস্তিষ্ক বা হৃৎপিণ্ডের কোনো অংশে রক্ত সঞ্চালনে বাধার সৃষ্টি করে। তখনই স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।

এ কারণেই করোনা রোগীদের অনেক সময় রক্তের তারল্য বাড়ানোর ওষুধ (ব্লাড থিনার) দেওয়া হয়। কিন্তু সেটা এমন মাত্রায় দেওয়া হয়, যেন অন্য কোনো সমস্যা দেখা না দেয়। কারণ, রক্তের অতিরিক্ত তারল্যের কারণে অনেক সময় দেহের ভেতরের কোনো অঙ্গে রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। এর ফলে জটিলতা দেখা দেয়।

বয়স্ক ব্যক্তি বা নানা ধরনের অসুস্থতায় আগে থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তবাহী নালির ভেতরের আবরণের সেলগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের ব্যক্তি কোভিডে আক্রান্ত হলে ব্লাড ক্লটিংয়ের আশঙ্কা বেশি থাকে।

করোনা ভ্যাকসিন
চলতি মাসেই আমাদের দেশে চীনের তৈরি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও মানবদেহের জন্য এটা কতটুকু নিরাপদ, তা পরীক্ষার কাজ শুরু হবে। টিকার তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার এই পর্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যাকসিনের এই পরীক্ষা প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণে করা হবে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু সময় লাগবে। হয়তো আগামী বছর আমরা এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের আগে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে করোনার টিকা দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু ইতিমধ্যে রাশিয়া তাদের তৈরি টিকা দেওয়া শুরু করেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরের শুরুতেই ওরা বাজারে টিকা সরবরাহ করতে পারবে। এখানে সমস্যা হলো, তাড়াহুড়া করে ক্লিনিক্যাল টেস্টের সময় সংক্ষিপ্ত করলে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই বাজারে টিকা আনতে হবে।

এসব বিষয়ে সম্প্রতি অ্যাপল নিউজে একটি বিস্তৃত লেখা ছাপা হয়েছে। অ্যাপল নিউজ একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, যেখানে প্রতিদিনের আলোচিত বিষয় সম্পর্কে খবরাখবর প্রকাশিত হয়। সেখানে সম্প্রতি (৪ সেপ্টেম্বর ২০২০) একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) বলেছে, যেকোনো ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের হার অন্তত ৫০ শতাংশ কমাতে সক্ষম হতে হবে। টিকার ফলাফল যদি এমন হয় যে রোগ উপশমের হার ৩০ শতাংশেরও কম, তাহলে সেটা অকার্যকর বলে গণ্য হবে। সংস্থাটি আরও বলেছে, টিকার নিরাপত্তা অন্তত তিন হাজার রোগীর ওপর এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়ে যাচাই করতে হবে।

তাহলে কীভাবে এত কম সময়ে টিকা বাজারে আনা হবে? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে এটা ঠিক যে এফডিএর শর্তগুলো ভাঙা যাবে না। তাদের শর্তের কারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অক্টোবর-নভেম্বরে টিকা পুরোপুরি অনুমোদন দেওয়া সম্ভব না। হয়তো ‘জরুরিভিত্তিক ব্যবহারের’ অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে, পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন এফডিএ হয়তো দেবে না।

দেশে কি সংক্রমণ কমছে?
কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে দেশে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুহার কমতির দিকে। অবশ্য ওঠানামা চলছে। আবার পরীক্ষার হারও কম। তাই সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না সংক্রমণ কমছে। দেখতে হবে আরও কিছুদিন।

অথচ এখন মানুষের মধ্যে এমন একটা ভাব এসেছে যেন করোনার ভয় আর তেমন নেই। এ জন্য অনেকেই মাস্ক পরেন না। এটা বিপজ্জনক। এ কারণে শুধু নিজের না, অন্যের বিপদও ডেকে আনা হচ্ছে। আমাদের আরও ধৈর্য ধরতে হবে। মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে এবং সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা দ্রুত সংক্রমণ কমিয়ে আনতে পারব।

আব্দুল কাইয়ুম: মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com