বাংলাদেশে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার এত হিড়িক কেন

পিএইচডি (ডক্টর অফ ফিলোসফি) ডিগ্রি অর্জন একাডেমিক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি শুধু একটি ডিগ্রি নয় বরং একটি গভীর এবং নতুন গবেষণার ফলাফল হিসেবে পরিগণিত হয়, যা বিদ্যমান জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। একাডেমিকদের জন্য এই ডিগ্রি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষায় অবদান রাখার এবং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও গভীরতর প্রেক্ষাপট প্রদান করে।

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারীরা তাঁদের গবেষণার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে নির্দেশনা দিতে সক্ষম হন। গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁদের সাফল্য এবং অবদান তাঁদের শিক্ষাদানের গুণগত মান উন্নত করে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পিএইচডি ডিগ্রির চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কিছু প্রধান কারণ এমন হতে পারে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার মান উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে। এ জন্য শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

পিএইচডি ডিগ্রি ধারকেরা সমাজে উচ্চ সম্মানের অধিকারী হন এবং তাঁদের নামের আগে ‘ডক্টর’ উপাধি ব্যবহার করতে পারেন, যা সামাজিক এবং পেশাগত ক্ষেত্রে তাঁদের পরিচিতি এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে।

অনেক সরকারি কর্মকর্তা বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য সরকারি অনুদান এবং সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন। এতে করে তাঁরা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় সুযোগ লাভ করেন এবং দেশের গবেষণা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন।

বাংলাদেশে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমান পিএইচডি ডিগ্রির দুরবস্থার একটি প্রধান কারণ হলো গবেষণার গুণগত মানের অবনতি। অনেক পিএইচডি প্রার্থী তাড়াহুড়ো করে থিসিস সম্পন্ন করেন, ফলে তাদের গবেষণার মূল যুক্তি এবং ভিত্তি অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। গবেষণার গভীরতা এবং মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি দেখা যায়।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক তাঁদের পিএইচডি থিসিস সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। গবেষণার মান এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত না থাকায় তাঁরা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করতে ব্যর্থ হন।

আমার কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে অনেকেই তাঁদের থিসিসের মূল যুক্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না। আমার কয়েকজন সহকর্মীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের থিসিস মুল আর্গুমেন্ট কী। অনেকেরই জবাব ছিল এ রকম, যে তাড়াহুড়া করে করেছি এখান কিছু মনে নেই। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের এক শিক্ষার্থী গ্রামার করেক্ট করে দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ করেছেন এবং থিসিসের বিষয়ে গভীরতর বিশ্লেষণ বা ভাবনা রাখতে পারেননি। এটি স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে গবেষণার মান এবং এর গভীরতা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গবেষণার গুণগত মানের অবনতির আরেকটি দিক হলো ইংরেজি ভাষার জ্ঞান। অনেক পিএইচডি প্রার্থী তাঁদের থিসিস সম্পন্ন করতে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রদের সাহায্য নেন, বিশেষ করে গ্রামার সংশোধনের জন্য। যদিও এটি সহায়ক হতে পারে, তবে এটি প্রমাণ করে যে গবেষকদের নিজেদের ভাষাগত দক্ষতা কতটা দুর্বল। গবেষণার মূল বিষয়বস্তু এবং যুক্তি স্পষ্ট করতে ভাষাগত দক্ষতা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বজনপ্রীতি একটি বড় সমস্যা। অনেক সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁদের ক্ষমতা এবং প্রভাব ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনেও অনেকেই রাজনৈতিক মতাদর্শ বিবেচনা করেন। অনেক সরকারি কর্মকর্তা তাঁদের ক্ষমতা এবং প্রভাব ব্যবহার করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হন এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এতে করে অনেক মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়।

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য অনেকেই একই রাজনৈতিক মতাদর্শের তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন করেন যাতে করে কোনো রকম প্রশ্ন এবং কঠোর ডিফেন্স ছাড়াই ডিগ্রি অর্জন করা যায়। এর একটি উদাহরণ হল পুলিশ সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ। তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের প্রক্রিয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে।

পিএইচডি ডিগ্রি একটি বিশেষজ্ঞ গবেষণার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে নতুন জ্ঞান এবং অবদান রাখার প্রক্রিয়া। এটি কেবলমাত্র ডিগ্রি নয় বরং গবেষণার মাধ্যমে সমাজে এবং একাডেমিক ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী অবদান রেখে যাওয়া। একজন গবেষককে তার গবেষণার মূল বিষয় এবং অবদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত এবং এটি তাঁর শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে হবে।

বাংলাদেশে অনেকেই পিএইচডি ডিগ্রি কেবলমাত্র তাঁদের নামের আগে ‘ডক্টর’ উপাধি ব্যবহার করার জন্য অর্জন করেন। এটি ঠিক যেমন অনেক রাজনীতিবিদ হজ পালন করেন। অনেক ক্ষেত্রে  শুধু ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক স্বার্থের জন্যই অনেকে এটা করেন।

পিএইচডি ডিগ্রি একটি মহৎ এবং সন্মানজনক ডিগ্রি, যা গবেষণার মাধ্যমে সমাজে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে গভীর অবদান রাখার সুযোগ প্রদান করে। বাংলাদেশে এই ডিগ্রির জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ এবং গুণগত মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যেন তাঁদের ক্ষমতা এবং প্রভাব ব্যবহার করে গবেষণার সুযোগ সীমিত না করে সে দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং গবেষণার ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পিএইচডি ডিগ্রির সঠিক অর্থ এবং মূল্যবোধ বজায় রাখা অতীব জরুরি।

বাংলাদেশে পিএইচডি ডিগ্রির বর্তমান দুরবস্থা গবেষণার মান, রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বজনপ্রীতির কারণে সৃষ্ট হয়েছে। গবেষণার মান উন্নয়নে এবং একাডেমিক ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করতে হলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি। পিএইচডি ডিগ্রির প্রকৃত অর্থ এবং মূল্যবোধ বজায় রাখতে গবেষণার গুণগত মান নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বজনপ্রীতি মুক্ত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।

পিএইচডি ডিগ্রি শুধু একটা উপাধি নয়। এটা একটা স্কলারশিপে সুস্পষ্ট অবদানের নাম । এটা ভুলে গিয়ে শুধু উপাধি নেওয়ার ‘লজ্জা’টা যেন আমাদের থাকে ।

*লেখক: একেএম আহসান উল্লাহ, শিক্ষক, ইউনিভারসিটি অফ ব্রুনেই দারুসসালাম, ব্রুনাই
akmahsanullah@gmail.com
*প্রবাস থেকে ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo.com