প্রায় ছয় মাস ধরে চলছে ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধ। দনবাস, খারকিভসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় সামরিক তৎপরতা শুরু করেছেন ইউক্রেনীয়রা। এই যুদ্ধে দেশটির অনেক স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই দেশটিতে ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। খুলেছে স্কুল। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০ শতাংশ স্কুল আবার চালু হয়েছে।
স্কুল শুরুর প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে এসেছে। অনেক স্কুলে আবার শিক্ষার্থীরা দেশটির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এসেছিল। স্কুলগুলো বেলুন ও রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছিল। অনেক দিন পর স্কুল খোলায় সবার হাতেই ছিল ফুল। সবাই দেশটির জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর শিক্ষকদের সঙ্গে নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারির পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে সশরীর স্কুল খুললেও এখনো আতঙ্কে আছে শিশুরা। তারা পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ১১ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থী অ্যান্ড্রি বলেছে, ‘যুদ্ধের চেয়েও ক্লাসে নতুন শিক্ষক নিয়ে আমি বেশ ভয়ে আছি।’
অ্যান্ড্রির মা ওলেনা বলেন, ‘আমরা শিশুদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। আর এই বিষয় তাদের শিক্ষার ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাই, আর স্ক্রিনে নয়, তারা শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করুক। আমরা আর ভয় পেতে চাই না।’
দেশটির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইউক্রেনে ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। তবে এখনই দেশের সব স্কুল চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। মাত্র ৪০ শতাংশ স্কুল আবার চালু হচ্ছে। এ কারণে দেশের হাজারো শিশু স্কুলে সশরীর পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
মারিয়ানা নামের এক নারীর ৯ বছর বয়সী ছেলে দানিলের কথা বলায় সমস্যার পাশাপাশি শিখন ঘাটতি রয়েছে। তিনি চান, দানিল সশরীর স্কুলে গিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে পড়াশোনা করুক। কিন্তু এত সমস্যার পাশাপাশি যুদ্ধের ভয়ও তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
মারিয়ানা বলেন, ‘সে (দানিল) প্রায় সময় রকেট! রকেট! বলে চিৎকার করে ওঠে। সে এখনো ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। আমি তাকে নানাভাবে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করি। এই মুহূর্তে স্কুলে দানিলের পড়াশোনা খুব দরকার। কিন্তু যুদ্ধের কারণে শহর থেকে অনেক স্পিচ থেরাপিস্ট চলে গেছেন। আমি জানি না, ওর পড়াশোনা কীভাবে হবে। কিন্তু ওর জন্য স্পিচ থেরাপিস্টের অনেক দরকার।’
পশ্চিমা কর্তকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলোতে শিশুদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবারগুলোকে বাধ্য করা হচ্ছে। আর ওই সব অঞ্চলের স্কুলে রাশিয়া থেকে নিয়ে আসা শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালানোর কাজ করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ইউক্রেন ও ইউক্রেনীয়দের জন্য যা বাস্তবসম্মত নয়, তা–ই পড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
কিয়েভের এক–চতুর্থাংশ অঞ্চলের চিত্র এটা। যেখানে ৭৫ শতাংশ স্কুল শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ফেরানোর জন্য প্রস্তুত থাকলেও মাত্র ২৫ শতাংশ স্কুল শিক্ষার্থীদের ফেরাতে চায়।
ইউক্রেনে কিয়েভের বাইরে অসংখ্য স্কুল রয়েছে। দেশটি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল, তখন থেকেই এসব স্কুল ছিল। ইউক্রেন–রাশিয়ার চলমান যুদ্ধে এসব স্কুলের খেলার মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দেয়াল ও জানালা সব ভেঙেচুড়ে গেছে। কোনো কোনো স্কুল রাশিয়ার সেনারা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে।
১ সেপ্টেম্বর প্রথম স্কুল শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা সহপাঠীদের সঙ্গে সুখকর কোনো স্মৃতি নিয়ে গল্প করতে পারেনি। দীর্ঘদিন পর দেখা হয়ে তাদের সবার মুখেই ছিল চলমান এই যুদ্ধে পরিবার ও নিজেদের বেঁচে থাকার গল্প।
ইউক্রেনের জেনারেল প্রসিকিউটর অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ হওয়ার পর থেকে অন্তত ৩৭৯ শিশু নিহত হয়েছে। ২২৩ শিশুর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা এলাকা থেকে জোরপূর্বক রাশিয়ায় স্থানান্তর করা ইউক্রেনীয়দের মধ্যে ৭ হাজার ১৩ জন শিশু ছিল।
গত ছয় মাসের যুদ্ধে দেশটিতে ২ হাজার ৪০০ স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৬৯টি স্কুল একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বেসামরিক এলাকা ও স্কুলগুলোতে এখনো হামলা চালানো হচ্ছে। নিহত হচ্ছে স্কুলগামী শিশুরা। এমন ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দেশটিতে সশরীর পাঠদানের জন্য স্কুল খুলেছে। তবে অভিভাবকেরা চাইলে সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে অনলাইন পড়াশোনায় যুক্ত করতে পারবেন।
বেলারুশ সীমান্ত থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মিখাইলো-কোটসুবিনস্কের একটি স্কুল যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি সপ্তাহে ওই স্কুল প্রাঙ্গণে সপ্তম গ্রেডের শিক্ষার্থী বই নিয়ে যাওয়ার জন্য জড়ো হয়েছিল। তারা সবাই অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে।
স্কুলটির শিক্ষক ওলেনা সেরদিউক বলেন, ‘আমরা অনেক দিন পর একে অপরকে দেখলাম। শিক্ষার্থীরা সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে।’
অনেক দিন পর বন্ধুদের কাছে পেয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীরা গল্পে মেতে ওঠে। সবার মুখেই শুধু যুদ্ধের গল্প। ওলেকসি লিটভিন নামের একজন বলেছে, গত ৪ মার্চ স্কুলে দুই দফায় রাশিয়ার মিসাইল হামলা হয়। বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল। বিস্ফোরণের সময় ভবন কেঁপে ওঠে। চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। এ ঘটনায় স্কুলের একজন নারী কর্মী নিহত হয়েছেন। এর এক দিন পর তারা পুরো পরিবার শহর ছেড়ে চলে যায়। ১ সেপ্টেম্বর স্কুল চালু হবে বলে তারা আবার ফিরে এসেছে।
দীর্ঘদিন পর স্কুল চালু হলেও অনেক অভিভাবক সন্তানদের এই চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির ভেতর স্কুলে পাঠাতে চান না।
এই মুহূর্তে শিশুদের জন্য স্কুলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারণে যেকোনো সময় তারা হামলার শিকার হতে পারে।ক্যাথেরিন এম. রাসেল, ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন এম. রাসেল বলেন, এই মুহূর্তে শিশুদের জন্য স্কুলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারণে যেকোনো সময় তারা হামলার শিকার হতে পারে।
যুদ্ধ শুরুর সময়েই ১৭ নম্বর ইরপিন স্কুল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউনিসেফের সহযোগিতায় স্কুলটি আবার পুনর্নির্মাণের পর চালু করা হয়েছে। স্কুলটির প্রথম গ্রেডের শিক্ষক ওলগা মালিওভানা বলেন, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এ বছরটি অন্যদের থেকে আমাদের কাছে আলাদা। শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। তবে আমরা সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছি। আশ্রয়কেন্দ্র করেছি।’
স্কুল চালু হলেও এখন পড়াশোনার চেয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হয় শিক্ষার্থীদের সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ইউক্রেনে ইউনিসেফের প্রতিনিধি মুরাত শাহিন বলেন, ‘দুই বছরের করোনাকাল ও ছয় মাসের যুদ্ধ শিশুদের বিকাশ, শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলেছে। তাই নানাভাবে আমাদের সেই স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে।’
কিছু কিছু স্কুল চালু হলেও দোনেস্ক অঞ্চলের ক্রামাতোরস্কে এই মুহূর্তে কোনো স্কুল চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, এখনো এ অঞ্চলে হামলা চলছে। পরিবারগুলো নিরাপদ এলাকায় চলে গেছে। এ কারণে একটি স্কুল পুরো আগের মতো স্বাভাবিক থাকলেও কোনো শিক্ষার্থী নেই। স্কুলটি দেখতে প্রায়ই আসেন স্কুলটির শিক্ষক ও পরিচালক আলেক্সান্দার নোভিকোভ।
আলেক্সান্দার নোভিকোভ বলেন, শিক্ষার্থীশূন্য একটি স্কুলে এলে অনেক হতাশ হতে হয়। স্কুলটিতে কোনো শিক্ষার্থী আসছে না, হাসছে না—এটা ভাবলে খারাপ লাগে।
বিবিসি, গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট, এএফপি ও রয়টার্স অবলম্বনে আবু হেনা মোস্তফা কামাল