আমার ছেলে অনিরুদ্ধ সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ে প্রাক্-প্রাথমিকে পড়াশোনা করে। ঈদের আগে থেকে সব মিলিয়ে টানা এক মাস স্কুল বন্ধ ছিল। বেশ লম্বা ছুটি হওয়ায় স্কুল খোলার দিন তাকে বলেছিলাম, তোমার স্যার কেমন আছেন, তুমি তা জিজ্ঞাসা করবে। সে মন খারাপ করে যা বলল, তাতে কিছুটা অবাক হয়েছি। যা বুঝলাম তা হলো, তাদের ক্লাসে পড়াশোনা ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে মানা।
অথচ ছাত্রদের আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চাওয়াটা অপ্রয়োজনীয় কিছু নয়। মূলত এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগের ঘাটতি (কমিউনিকেশন গ্যাপ) রয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে কী চায়, শিক্ষকেরা তা বুঝতে চান না কিংবা বুঝলেও তাঁরা তা কর্ণপাত করতে রাজি নন।
অথচ তার বাংলা বইয়ের কভার পেজে লেখা, ‘আনন্দ করে বাংলা শিখি’। গণিত বইয়ে লেখা, ‘আনন্দ করে গণিত শিখি’। ইংরেজি বইয়ে লেখা, ‘Fun with English’। যে ক্লাসে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ছাত্রদের কিছু বলতে বারণ, সেখানে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় কতটুকু আনন্দ আছে জানা নেই।
আমাদের ছেলেবেলায় পড়ালেখার ধরন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্কুলে সিস্টেমেটিক পড়াশোনায় আনন্দ না থাকলেও বিদ্যালয়ের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ সহজেই শৈশবকে প্রাণবন্ত রাখত। সহপাঠী কিংবা শিক্ষকদের আন্তরিকতা মধুর ছিল। কোনো ছাত্র কিছু বলতে চাইলে শিক্ষক মন দিয়ে শুনতেন। শিক্ষকেরা রাগী হলেও ছাত্রদের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল।
তাই কোনো ছাত্র ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে, বাড়িতে কাউকে পাঠিয়ে স্কুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হতো। এখনকার সময়ের মতো তখন এত স্কুল ছিল না। সে জন্য কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। গল্প কিংবা আড্ডার ছলে দলবদ্ধভাবে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ ছিল অন্য রকম। মাঝেমধ্যে গাছতলায় বসে ক্লাস করেছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড়দের কাছ থেকে জোর গলায় নামতা গুনতে শিখেছি। তাতে ছিল এক ভিন্নমাত্রার অনুভূতি। এখন সে রকম আনন্দ নেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়েছে। স্কুলের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ যেমন নেই, তেমনি পাঠদানের প্রক্রিয়াও বদলে গেছে। এখন গ্রামের স্কুলগুলোতে খোলা বারান্দা কিংবা খেলার মাঠ থাকলেও শহরাঞ্চলে সে সুবিধা নেই। বিদ্যালয়ের চারপাশে বন্দিশালার মতো রয়েছে উঁচু প্রাচীর করা বন্ধ গেট। এসব বদ্ধ পরিবেশ এবং রুটিনবদ্ধ ক্লাস কোমলমতি শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জোর করে যা শেখানো হয়, তা মুখস্থ ছাড়া আর কিছু নয়।
শিশু শ্রেণি থেকে সব শ্রেণিতেই এমন অবস্থা চলমান। অথচ প্লে বা শিশু শ্রেণিতে পড়াশোনার চেয়ে স্কুলে বেশি সময় সহশিক্ষা কার্যক্রমের (এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটি) সঙ্গে জড়িত থাকা উচিত। যাতে আনন্দের মাধ্যমে শিশুরা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারে। শিক্ষায় উন্নত দেশগুলোতে শিশুরা যাতে আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখা হয়। অন্যদিকে পড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার জন্যও প্রচুর সময় দেওয়া হয়।
একসময় ব্র্যাকের পরিচালনায় গ্রামাঞ্চলে স্কুলগুলোর পড়াশোনা নজর কাড়ত। ব্র্যাকের প্রতিটি স্কুলে একজন দক্ষ শিক্ষক ছিলেন। তাতে নির্দিষ্টসংখ্যক ছাত্র ছিল। পাঠদানের প্রক্রিয়াও ছিল অত্যন্ত চমৎকার। ক্লাসের শুরুতে এবং শেষে ছোট ছোট ছড়া, কবিতা আবৃত্তি করা হতো। ক্লাসে গল্প বলা কিংবা গান গাওয়া ছাত্ররা উপভোগ করত। বিভিন্ন ছবি কিংবা কার্ড দেখিয়ে পাঠদান করা হতো। কয়েক সপ্তাহ পরপর ছাত্রদের গল্পের বই দেওয়া হতো। তাতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ তৈরি হতো।
এখন বিদ্যালয় বেড়েছে, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে। শিক্ষার্থী বেড়েছে, শিক্ষার হারও বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও আনন্দের মাধ্যমে পাঠদান কতটুকু এগিয়েছে, জানা নেই। বইয়ের বোঝা ভারী হয়, কিন্তু আনন্দের অনুভূতি নেই। একগাদা বই নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করা অসহনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতা রয়েছে।
ফলে ছাত্ররা মুখস্থ পড়া গলাধঃকরণ করে। সর্বোপরি ভালো নম্বরের প্রত্যাশায় এবং পরীক্ষার মতো ভীতিকর অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রাথমিক স্তরেও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে হয়। সম্প্রতি এক জরিপেও সে তথ্য উঠে এসেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলার ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৪০৮ জনের ওপর জরিপ চালিয়েছে।
তিনটি জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর পরিচালিত জরিপের তথ্যমতে, সেখানকার এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী ‘প্রাইভেট টিউরের’ কাছে পড়ে। আর প্রাইভেট টিউটরের কাছে না পড়লে শিক্ষার্থীরা ‘অপ্রত্যাশিত সমস্যায়’ পড়ে। এমনকি প্রাইভেট টিউটরের কাছে না পড়লে শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হবে বলে মনে করেন জরিপে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। এ ‘অপ্রত্যাশিত সমস্যা’ আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বহুবার দেখেছি।
এখন প্রাথমিক স্তরেও দেখা দিয়েছে। জরিপে তিনটি জেলার কথা উল্লেখ থাকলেও অন্যান্য জেলায় সমস্যা যে নেই, তা বলা যাবে না।
হিন্দি ভাষায় রচিত ‘তারে জামিন পর’ সিনেমাটি আমরা অনেকেই দেখেছি। ছবিটির কাহিনি প্যাট্রিসিয়া পোলাক্কোর বই ‘Thank You, Mr. Falker’ থেকে অনুপ্রাণিত। সিনেমাটি মূলত একটি ছেলের জীবননির্ভর কাহিনি নিয়ে রচিত। ছোটবেলা থেকে ছেলেটি ‘ডিসলেক্সিয়া’রোগে আক্রান্ত ছিল। যার নেতিবাচক প্রভাবে নিত্যদিনের জীবনযাপনসহ পড়াশোনায় মনঃসংযোগ ব্যাহত হতো। ভালো লাগার কোনো মুহূর্তকে খুঁজে পাওয়া তার জন্য দুষ্কর ছিল। মাঝেমধ্যে ছবি এঁকে না–বলা কথা তার মাকে বোঝাতে চাইত।
ব্যস্ত জীবনে তার মায়ের সে আঁকিবুঁকি দেখার সময় হয় না। অপর দিকে বাবা তো রেগেই আগুন। সেখানে তার শিক্ষককে দেখেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের একজন মানুষ। যার ভালোবাসার পরশে ছেলেটি পেয়েছে দুরন্ত শৈশবকে। যেখানে মা–বাবা ছেলেকে বুঝতে পারেননি, সেখানে শিক্ষক ছেলেটির আধবোঝা কুঁড়ির শৈশবকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
আমাদের স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষকও যদি সে রকম হতেন। অকারণেই মুখের গাম্ভীর্য ধরে না রাখতেন, হাসি-আনন্দে স্কুলে পাঠদান করাতেন। তাহলে অনেক শিক্ষার্থীই তাদের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারত। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই তাদের প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেতে হতো না। কারণ, শ্রেণিকক্ষ হলো শিক্ষার মূল স্থান এবং শিক্ষক হলেন এই প্রক্রিয়ার মূল পরিচালক।
সে জন্য শিক্ষকদের মনের মতো করে ছাত্রদের বুঝতে হবে। তারপর শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে। শিক্ষকেরা আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললে শিক্ষার্থীরাও অতি উৎসাহে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। মূলত, কী শেখানোর পরিবর্তে কীভাবে শেখানো যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষাকে আনন্দের উপকরণ হিসেবে উপস্থাপন করাও নৈপুণ্যের।
বিচিত্র উপকরণের মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় পাঠদানে শিক্ষায় আনন্দ আসে। তাই শিখনপ্রক্রিয়ায় নানা বর্ণের কার্ড, চার্ট, মডেলের আয়োজন করা যেতে পারে। তাতে শিশুর প্রতিভা বিকশিত হবে। মূলত আনন্দের মাধ্যমে পাঠদান হবে মূল লক্ষ্য। সে জন্য আর্থসামাজিক অবস্থান–নির্বিশেষে শিশুদের পড়াশোনাকে আনন্দপাঠ করে তুলতে হবে।
লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক