উপরে বাঁ থেকে মনজুর আহমদ ও রাশেদা কে চৌধূরী; নিচে বাঁ থেকে কাজী ফারুক আহমেদ ও বিনায়ক সেন
উপরে বাঁ থেকে মনজুর আহমদ ও রাশেদা কে চৌধূরী; নিচে বাঁ থেকে কাজী ফারুক আহমেদ ও বিনায়ক সেন

শিক্ষাব্যবস্থার নিবিড় পর্যালোচনা দরকার

শিক্ষা নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। কখনো নানা ধরনের পরীক্ষা চালু করা হয়, আবার কখনো তা বাদও দেওয়া হয়। একেক সময় একেক পদ্ধতি চালু করা হয়। তাই শিক্ষাব্যবস্থার নিবিড় পর্যালোচনা করা দরকার। শিক্ষাকে গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মনজুর আহমদের লেখা একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর বইয়ের ওপর এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে লেখকসহ শিক্ষা ও গবেষণা–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা এসব কথা বলেন। আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বইটিতে স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিশদ পর্যালোচনা ছাড়াও কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর নিয়ে আলোচনা আছে। বিভিন্ন সরকারের সময় নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন সত্ত্বেও শিক্ষার প্রত্যাশিত রূপান্তর ঘটেনি। এই বইয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সেই রূপান্তর এবং এ ক্ষেত্রে নানা করণীয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন ড. মনজুর আহমদ। প্রায় পৌনে চার শ পৃষ্ঠার এই বইয়ে চারটি পর্বে ১৪টি অধ্যায়ের মাধ্যমে শিক্ষার নানা হালচাল তুলে ধরা হয়েছে। বইটির মূল্য ৮৫০ টাকা।

আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে বইয়ের লেখক মনজুর আহমদ বলেন, শিক্ষা বহুমাত্রিক জটিল একটি বিষয়। দেশের চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী এবং লাখ লাখ শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক আছেন। মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই শিক্ষার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত। শিক্ষা নানাভাবে তাঁদের জীবনকে প্রভাবিত করে। এ নিয়ে তাঁদের মতামতও আছে। সবার মতকে বিচার-বিশ্লেষণ করে লক্ষ্য–কৌশল স্থির করতে হবে। তবে সেখানে নেতৃত্বের একটি অভাব আছে। সামগ্রিকভাবে মূলে না গিয়ে লক্ষণ ধরে চিকিৎসা হয়েছে। সে জন্যই শিক্ষা নিয়ে নানা রকম সিদ্ধান্ত এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখা যায়। সমস্যার মূলে গিয়ে সমস্যার সমাধান করা দরকার।

মনজুর আহমদ বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, দেশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য শিক্ষা ছাড়া এগোনো যাবে না। তাই শিক্ষাকে গতানুগতিক অপরাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাতিরে, দেশের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাকে গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে রেখে এর সমস্যার সমাধান করতে হবে।

আলোচনায় অংশ নেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, শুধু ব্যবস্থা দেখলে হবে না, শিক্ষা ব্যবস্থাপনাটি কোন জায়গায় আছে, সেটিরও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা দরকার। মাঠের বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যতই একাডেমিক আলোচনা করা হোক না কেন, সেটি একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে। তাই গবেষণার মাধ্যমে বাস্তবতা তুলে আনতে হবে। সবকিছুর আগে মানুষের কথা শুনতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, স্বল্প মানের শিক্ষা ও অসংগতি নিয়ে একটি পর্যায়ে আমরা আসতে পেরেছি। কিন্তু ২০৪১ সাল পর্যন্ত সামনের বছরগুলোর জন্য আমূল পরিবর্তন আসতে হবে সমাজের সব ক্ষেত্রে।

শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রবীণ শিক্ষকনেতা কাজী ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, জাতীয়করণ আর সরকারীকরণ কি এক? যেখানে স্বায়ত্তশাসন নেই, যেখানে শিক্ষকের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার নেই, সেটিকে জাতীয়করণ বলতে তিনি রাজি নন।

বিআইডিএসের গবেষক জুলফিকার আলী বলেন, শিক্ষা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধরুন আগে একধরনের ব্যবস্থা ছিল, পরে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হলো। আজকে বলা হচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতি কাজ করছে না। নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নামে পাবলিক পরীক্ষা ছিল। তারপর পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হলো। আজকে এসে বলা হচ্ছে এটি সঠিক ছিল না। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাপনাসহ পুরো বিষয়টির নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা দরকার।

একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর বইয়ের উচ্চশিক্ষার অংশ নিয়ে আলোচনা করেন বিআইডিএসের গবেষক শিবান শাহানা। তিনি বলেন, প্রায় ২৩ শতাংশ তরুণ–তরুণী বা যুবসমাজ উচ্চশিক্ষার জন্য আসছেন। কিন্তু তাঁরা যখন উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করছেন, তার দুই–তিন বছরেও প্রায় ২৮ শতাংশ, আরেকটি গবেষণার তথ্যানুযায়ী প্রায় ৬৬ শতাংশের মতো কাজ পাচ্ছেন না।

মানবাধিকারকর্মী শিপা হাফিজা বলেন, লৈঙ্গিক সমতা, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি বিষয় শিক্ষায় সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটি ছেলে আরেকটি মেয়েকে বিদ্রূপ করছে, কৌতুক করছে, হয়রানি করছে। কিন্তু ছেলেরা এ নিয়ে কিছু বলে না। কিন্তু জানে, এটি অন্যায়। কেন বলে না, কারণ স্কুলে শেখায়নি। তাই এ বিষয়টিও শেখাতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস ও ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ আহমেদ বলেন, এই বই (একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর) চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।

দেশের ৫০ বছরের ক্রমবিকাশ নিয়ে এই বই একটি বড় কাজ বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানজুমা আখতার।

প্রারম্ভিক বক্তব্যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বইটির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বই বের করেছে প্রথমা প্রকাশন। সেই ধারাবাহিকতায় এই বইয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি খুবই প্রয়োজনীয় একটি বই।

প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক জাভেদ হুসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষ ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, ব্রিটিশ হাইকমিশনে কর্মরত গোলাম কিবরিয়া, বেসরকারি সংস্থা এএসপিবিএইর উপদেষ্টা কে এম এনামুল হক, শিক্ষক রণজিৎ পোদ্দার এবং ব্র্যাকের কর্মকর্তা দিলরুবা সুলতানা। তাঁদের কেউ কেউ বইয়ের লেখকের কাছে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন রাখেন।

এসব প্রশ্নের জবাব দেন অধ্যাপক মনজুর আহমদ। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার বিভিন্ন উপখাত নিয়ে প্রথম আলোর উদ্যোগে আলাদা গোলটেবিল বা আলোচনা করার পরামর্শ দেন।

অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক মেরিনা ইয়াসমিন।