শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কেন সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন

গতকাল টানা তিন দিনের ‘সর্বাত্মক কর্মবিরতি’ শুরু করেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আজ বুধবার বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ চত্বরে
 ছবি: সোয়েল রানা

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে সব ক্যাডারে একই সঙ্গে বিসিএস প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব ধাপ পেরিয়ে চাকরি পান। এরপরও শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

পদায়ন ও সংবর্ধনা

সব ক্যাডারের প্রথম যোগদান হয় তাঁদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে। শিক্ষা ক্যাডারের যোগদান হয় পদায়নকৃত কলেজে। সব ক্যাডারে যোগদানের পর টিএ/ডিএ পায়, যেটা শিক্ষা ক্যাডার পায় না। সব ক্যাডারের সদস্যদের যোগদানের সময় সংবর্ধনা দেওয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে এটা বিরল। কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু আয়োজন করা হলেও তা নগণ্য।

বনিয়াদি প্রশিক্ষণে সমস্যা

বিধি অনুসারে সব ক্যাডারের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ হয় ছয় মাসের এবং যা অনুষ্ঠিত হয় সাভারের জাতীয় লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিপিএটিসি)। অথচ শিক্ষা ক্যাডারকে এ ক্ষেত্রে চার মাসের ট্রেনিং দেওয়া হয়। বিপিএটিসিতে তাঁদের ডাকা হয় না। এমনকি অন্যান্য ক্যাডারদের বনিয়াদি সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী উপস্থিত থাকেন, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত তো থাকেনই না, শুধু অনলাইনে যুক্ত থাকেন। অথচ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তার সংখ্যা সর্বাধিক।

চাকরি স্থায়ীকরণ সমস্যা

চাকরির বয়স দুই বছর, বনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস থাকলে অন্য সব ক্যাডারে দুই বছর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকরির স্থায়ীকরণের আদেশ জারি হয়। কিন্তু জাতীয়করণ করা কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষা ক্যাডারে বিভাগীয় মামলার জট ও অন্যান্য প্রশাসনিক জটিলতায় চাকরি স্থায়ীকরণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করা হয়েছে, এমনকি তারা সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। ফলে ৩৫তম থেকে ৩৮তম বিসিএস পর্যন্ত চাকরি স্থায়ীকরণ ঝুলে রয়েছে।

প্রমোশন অসুবিধা

চাকরির বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর হলে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সব ক্যাডার পদোন্নতি (ষষ্ঠ গ্রেড পেলেও), শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের পদোন্নতি দেওয়া হয় না। অনেক স্যাররা ১০ থেকে ১২ বছর একই পদে চাকরি করেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাচভিত্তিকও পদোন্নতি হয় না। ফলে নানা জটিলতায় ভরপুর এ ক্যাডার। অন্য ক্যাডারে পদোন্নতির জন্য পদ খালি থাকার প্রয়োজন হয় না, তাঁরা সুপার নিউমারি পদে পদোন্নতি পান আর শিক্ষা ক্যাডারে পদ খালি নেই বলে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। আবার নতুন পদ সৃষ্টিও করা হয় না। কলেজগুলো চলছে দীর্ঘদিনের পুরোনো পদকাঠামো দ্বারা। এ ছাড়া বিধিতে প্রথম পদোন্নতির জন্য পদ খালি থাকার শর্ত নেই। সামাজিক ও আর্থিকভাবে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

পদ দখল ও অবস্থান হারানো

ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস-১৯৮০ অনুযায়ী সব ক্যাডার কোন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। এ রুলস শুধু শিক্ষা ক্যাডারের সময় মানা হয় না। তাদের বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কোনো দপ্তর নেই। শিক্ষা ক্যাডারের সিডিউলভুক্ত পদগুলো যা আছে, তা সময় সুযোগে অন্যরা দখল করে নিচ্ছেন। কারিগরি, মাদ্রাসা, প্রাইমারি অধিদপ্তর, এনটিআরসিএসহ অনেক দপ্তরে শিক্ষা ক্যাডারের জন্য যে পদ ছিল, তা দখলদারগণ কেড়ে নিচ্ছেন।

গ্রেড অসুবিধা

প্রায় সব ক্যাডারে গ্রেড-১, গ্রেড-২, গ্রেড-৩ পদ আছে, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের নেই। আদালতের রায়ে অধ্যাপকেরা গ্রেড-৩ পেলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। অথচ এ ক্যাডারে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ দিয়ে কাজ করার মতো অনেক যোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন। এমনকি ডেপুটেশনে উপসচিব মর্যাদায় স্থানান্তরিত হওয়ার সময় অন্য ব্যাচের সঙ্গে ন্যূনতম ১০ ব্যাচ পার্থক্য থাকে, যা অত্যন্ত লজ্জার।

বিধিবিধান প্রণয়ন

শিক্ষা ক্যাডারের জন্য যে বিধি প্রণয়ন হচ্ছে, তা প্রণয়ন করছে বিশেষ ক্যাডার। এমনকি শিক্ষাস্তরের বিভিন্ন কাঠামোগত রূপরেখা প্রণয়ন ক্ষেত্রে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বঞ্চিত। ফলে শিক্ষার গুণগতমান পরিবর্তনের জন্য এ বিধিগুলো কোনো কাজে আসছে না, উল্টো শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ছে।

উচ্চশিক্ষা অর্জনে অসুবিধা

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারদের উচ্চশিক্ষার জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’, ‘বঙ্গবন্ধু ওভারসিস স্কলারশিপ’ কিংবা কমনওয়েলথের মতো স্কলারশিপ খুবই দুর্লভ বিষয়। অথচ অন্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে তা অত্যধিক সুবিধাপ্রাপ্ত হলেও শিক্ষা ক্যাডারে তা নিজ যোগ্যতা বলে আদায় করে নিতে হয়, যা ১ শতাংশের কম।

গবেষণায় অসুবিধা

সমসাময়িক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য দেশের প্রায় ৯৯ ভাগ কলেজের নেই গবেষণার কোনো ফান্ড কিংবা গবেষণার সুযোগ-সুবিধা। ফলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দিন দিন অনগ্রসর জাতিতে পরিণত হচ্ছে।

বদলির সুযোগ-সুবিধা

অন্য ক্যাডারে নিয়মিত বদলি কার্যক্রম চালু থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারে যুগের পর যুগ, এমনকি অনেকেই এক স্টেশনে সারা জীবন চাকরি শেষ করেন। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কলেজগুলোয় সুবিধাভোগী কিছু শ্রেণির শাসক প্রভাব খাটিয়ে তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের সারা জীবনের জন্য পদায়িত করে দেন।

ভ্যাকেশন বিভাগের অসুবিধা

শিক্ষা ক্যাডার ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় অবসরে যাওয়ার সময় তাঁরা অন্যদের থেকে ১০-১৫ লাখ টাকা কম পান। কিন্তু ক্যাডার সদস্যরা বাস্তবে অবকাশ কাটাতে পারেন না। কারণ, প্রতিটি কলেজে অনার্স ডিপার্টমেন্ট থাকায় সারা বছরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ লেগে থাকে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুবিধা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত না হয়েও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা সারা বছরই স্বল্প মূল্যে নির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান ছাড়াই খাতা দেখা, পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন, ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়া, নিজ দায়িত্বে কাঁধে করে খাতা নিয়ে আসা ও পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজও করে থাকেন।

আবাসনব্যবস্থা

অন্য ক্যাডারগুলোয় কর্মকর্তাদের জন্য জেলাভিত্তিক থাকার ব্যবস্থা থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। সামান্য কিছু টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এ ব্যবস্থা থাকলেও তার বেহাল দশা। একই সঙ্গে অধিকাংশ কলেজে নেই কোনো ডরমেটরি সিস্টেম।

পরিবহন অসুবিধা

অন্য সব ক্যাডারে নবম গ্রেড থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রয়োজনে সরকারি গাড়ি সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যক্ষ মহোদয়দের (গ্রেড-৩) হয়েও তা দেওয়া হয় না। সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠানে বা সরকারি কলেজে গাড়ি সুবিধা আছে, কিন্তু অধিকাংশ কলেজে তা নেই। ফলে পরীক্ষা চালানোর সময় শিক্ষা ক্যাডারের বড় বড় কর্মকর্তাদের ভ্যানে বা ভাড়া গাড়িতে প্রশ্নপত্র আনতে হচ্ছে বা অন্যান্য কর্মকাণ্ড সারতে হয়। কিংবা ছাত্রছাত্রী পরিবহনের জন্য নেই কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা।

প্রশিক্ষণ অসুবিধা

অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যরা সমগ্র চাকরিজীবনে ন্যূনতম ১০০-১৫০টি অভ্যন্তরীণ, বিভাগীয় ও বিদেশে ট্রেনিং সুবিধা পান, অথচ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা দেশ ও জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করলেও সর্বসাকল্যে ৩০-৪০টি ট্রেনিংয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান কি না সন্দেহ রয়েছে, যা কিনা নির্ভর করে একটি বিশেষ শাসক শ্রেণির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।

বিবিধ সমস্যা

শিক্ষা ক্যাডারের জন্য নতুন আরও একটি সমস্যা যোগ হয়েছে চার থেকে পাঁচ বছরে চাকরি স্থায়ী হচ্ছে না। ফলে উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নেওয়া, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দিতে পারছেন না। বেতন কাঠামোতেও রয়েছে অন্যান্য ক্যাডারদের সঙ্গে বৈষম্য।

আমাদের চাওয়া-পাওয়া

আন্তক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণে এবং দেশ ও জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা খাতের ভারসাম্য বজায় রাখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন এখন অন্যতম দাবি। এ আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন যারা মানেন না, দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যাঁরা পিছিয়ে দিয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতিসাধন করতে চান, তাঁদের বিরুদ্ধে।

*লেখক: খোন্দকার রেজওয়ান তানভীর, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা, ৪০তম বিসিএস ব্যাচের পক্ষ থেকে।