বিজ্ঞানী অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুন
বিজ্ঞানী অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুন

মাইক্রোআরএনএ ক্যানসার-ডায়াবেটিসের কারণ জানতে সাহায্য করবে

২০২৪ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুন। মাইক্রোআরএনএ (microRNA) আবিষ্কার ও ট্রান্সক্রিপশন-পরবর্তী জিন নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা নিয়ে গবেষণার জন্য তাঁরা এ পুরস্কার পান। ভিক্টর অ্যামব্রোস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল স্কুলের মলিকুলার মেডিসিন প্রোগ্রামের সিলভারম্যান প্রফেসর অব ন্যাচারাল সায়েন্সেস। গ্যারি রাভকুন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক এবং ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের গবেষক।

এই যুগান্তকারী আবিষ্কার জীববিজ্ঞানে জিন নিয়ন্ত্রণসম্পর্কিত গবেষণার পথে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। জেনেটিক তথ্য ডিএনএ (DNA) থেকে এমআরএনএ (mRNA) তে প্রবাহিত হয় ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে। এরপর এমআরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরি হয়, যা অনুবাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তবে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে ডিএনএ একই হলেও বিভিন্ন কোষের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিনের উপস্থিতি দেখা যায়, যার ফলে কোষগুলো বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। এই ভিন্ন প্রোটিনের উপস্থিতি এবং কার্যসম্পাদন নির্ভর করে নির্দিষ্ট জিন নিয়ন্ত্রণের ওপর, যা প্রতিটি কোষকে তার নির্দিষ্ট কার্য পরিচালনা করতে সাহায্য করে।

জিন নিয়ন্ত্রণের এই প্রক্রিয়া এতটাই নিখুঁত যে পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোষগুলো তাদের কার্যকারিতা পরিবর্তন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো কোষের জিন নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে কোষে অবাঞ্ছিত প্রোটিনের তৈরি হতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে ক্যানসার বা ডায়াবেটিসের মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্য সঠিক জিন নিয়ন্ত্রণ জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাইক্রোআরএনএ এই জিন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি ছোট আরএনএ অণু, যা এমআরএনএর ওপর কাজ করে এবং প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার হওয়ার আগে বিজ্ঞানীরা এই নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। ড. অ্যামব্রোস এবং ড. রাভকুনের কাজের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে মাইক্রোআরএনএ এমআরএনএর কার্যকলাপকে স্থগিত করে বা নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে নির্দিষ্ট প্রোটিনের তৈরি হওয়া বা না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এই আবিষ্কারের মাধ্যমে অ্যামব্রোস ও রাভকুন জীববিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তাঁদের কাজ শুধু মাইক্রোআরএনএর ভূমিকা নয়, বরং জীববিজ্ঞানের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে জিন নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়ার জটিলতাও উন্মোচন করেছে। তাঁদের এই গবেষণা ক্যানসার, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য জটিল রোগের কারণ উদ্‌ঘাটনে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন ধরনের থেরাপির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ড. ভিক্টর অ্যামব্রোস এবং ড. গ্যারি রাভকুনের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগ নিরাময়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অধ্যাপক ড. ভিক্টর অ্যামব্রোস এবং অধ্যাপক ড. গ্যারি রাভকুনের মাইক্রোআরএনএ এবং পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল জিন নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ এবং গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের কাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে:

1. Ambros, V. (2004). The functions of animal microRNAs. Nature, 431(7006), 350-355.

এই প্রবন্ধে ড. অ্যামব্রোস মাইক্রোআরএনএর মূল কার্যক্রম এবং বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা তুলে ধরেছেন।

2. Bartel, D.P. (2004). MicroRNAs: Genomics, biogenesis, mechanism, and function. Cell, 116(2), 281-297.

মাইক্রোআরএনএ কীভাবে কাজ করে এবং এটি কীভাবে জিন নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়ায় অবদান রাখে, তা এই প্রবন্ধে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

3. Lee, R. C., Feinbaum, R. L., & Ambros, V. (1993). The C. elegans heterochronic gene lin-4 encodes small RNAs with antisense complementarity to lin-14. Cell, 75(5), 843-854.

এই প্রবন্ধ লিন-৪ জিনের মাইক্রোআরএনএর প্রথম আবিষ্কার নিয়ে এবং এর সঙ্গে জিন নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক নিয়ে আলোচিত।

4. He, L., & Hannon, G.J. (2004). MicroRNAs: Small RNAs with a big role in gene regulation. Nature Reviews Genetics, 5(7), 522-531.

এই রিভিউ প্রবন্ধ মাইক্রোআরএনএর মূল ভূমিকা এবং এটি কীভাবে রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হতে পারে, সেই প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।

5. Reinhart, B., Slack, F., Basson, M. et al. The 21-nucleotide let-7 RNA regulates developmental timing in Caenorhabditis elegans. Nature 403, 901–906 (2000). C. elegans-এর হেটেরোক্রনিক জিন পথের অংশ হিসেবে let-7 জিনটি সময়মতো নিয়ন্ত্রিত হয়ে বিকাশের ধাপগুলোর সঠিক সমন্বয় করে, যার ঘাটতি বা আধিক্য কোষের গন্তব্যের সময় পরিবর্তন ঘটায়।

*লেখক: মো. তৌহিদুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, অনকোলজি বিভাগ, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়