প্রাথমিক শিক্ষা যেমন একটি মানবশিশুর ভিত্তি, তেমনই একটি জাতিরও ভিত্তি বলে আমি মনে করি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নাজুক অবস্থা চলছে। এর পুনর্গঠন জরুরি। আর সেই পুনর্গঠন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন। দেশের অন্যান্য খাতের মতোই এই খাতের অবস্থা। জাতিকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্য এখানে গৌণ। নীতিনির্ধারকেরা কয়েক বছর ধরে এলোপাতাড়ি নানা সিদ্ধান্তে জর্জরিত করেছেন খাতটিকে, যার কুফল ভোগ করছে শিক্ষার্থীরা।
সমাজে প্রচলিত আছে, শিক্ষকেরা সমাজের সমাদৃত ব্যক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দিনকে দিন কমছেই। কারণ, বর্তমান সমাজব্যবস্থা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে মানুষের মূল্যায়ন হয় তাঁর বেতনকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ১৩ গ্রেডের, তথা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। একদিকে তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা, অন্যদিকে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও নেই। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তো পরের বিষয়, শিক্ষকেরা জেলা–উপজেলার শিক্ষা অফিসেও যথাযথ সম্মান পান না। এ কারণে শিক্ষকদের মধ্যে হীনম্মন্যতা পরিলক্ষিত হয়। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও কোনো গুরুত্ব নেই। এ শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে চলছে, কীভাবে চললে এর দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব, সে ব্যাপারে একজন সহকারী শিক্ষক যতটা বলতে পারেন বা জানেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সেটা জানা বা বোঝা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেন না তাঁরা।
জাতি পুনর্গঠনের এ সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কিছু বলতে চান, যা পূরণ করা গেলে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। দাবিগুলো হলো-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিশ্চিত করা;
একটি মানসম্মত পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি প্রণয়ন; এবং এ ব্যাপারে শিক্ষকদের মতামত গ্রহণ;
পদন্নোতি: সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে ১০০ শতাংশ পদোন্নতির ব্যবস্থা। ৪০ শতাংশ সরাসরি ও ৬০ শতাংশ বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি। পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগে সহকারী শিক্ষকদের ৪০ শতাংশ বিভাগীয় প্রার্থিতার সুযোগ;
শিক্ষকদের উপজেলা পর্যায়ে দাপ্তরিক কাজের জন্য হয়রানি না করার নিশ্চয়তায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা;
শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো তৈরি করা, যেখানে প্রাথমিকের শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে থাকতে হবে না। যার ফলে শিক্ষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে;
জেলা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। প্রধান শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। সহকারী শিক্ষকদের পাঠদানে সৎ ও সুকৌশলী হতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সহকারী শিক্ষকদের পাঠদানে স্বাধীনতা থাকতে হবে, শিক্ষকেরা যাতে প্রয়োজনে কঠোর হতে পারেন। এ জন্য তাঁদের যেন আতঙ্কে থাকতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই আলাদা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কাউকে অল্প বোঝালেই বোঝে, কাউকে একটু বেশি বোঝাতে হয়; আবার কাউকে একটু কঠোরভাবে বলতে হয়, কিছুটা ভয় দেখিয়ে, মা–বাবার মতো একটু শাসনও করতে হয়। কিন্তু শিক্ষককে যদি সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয় যে শিক্ষার্থী ও তাঁর অভিভাবক এ ইস্যুতে চাইলেই তাঁদের ফাঁসিয়ে দিতে পারেন, তাহলে যথাযথ শিক্ষা প্রদান প্রশ্নবিদ্ধ হবে, এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকেরা তখন চাকরি বাঁচাতে যেমন চলছে চলুক নীতিতে কাজ করবেন, যেটা এখন হচ্ছে;
পরীক্ষাব্যবস্থা পুনর্বহাল করা, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতার মনোভাব ফিরিয়ে আনবে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন জরুরি। বর্তমানে দেখা যায়, কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি এড়াতে অনুপযুক্ত শিক্ষার্থীদের নানা উপায়ে পাস করিয়ে দেওয়া হয়। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। আমরা যাতে এত বেশি শতাংশ পাস করেছে ভেবে তৃপ্ত না হই। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, ভেতরটা পুরোই ফাঁকা।
বিদ্যালয়ে অফিশিয়াল বা দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অফিস সহকারী নিয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
*লেখক: অনামিকা মণ্ডল, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক